নয়া ব্যাংকের শুরুতেই হোঁচট

শুরুতেই হোঁচট খেয়েছে নতুন ব্যাংকগুলো। রাজনীতিনির্ভরতায় জন্ম নেয়া এসব ব্যাংক তাকিয়ে আছে রাজনীতির দিকে। বর্তমানে রাজনৈতিক পরিস্থিতিও ভাল যাচ্ছে না। তাই বড় দুঃসময় পার করছে নতুন এসব ব্যাংক। নির্বাচনপূর্ব সহিংসতা এবং নির্বাচনোত্তর অনিশ্চয়তার দোলাচলে দুলছে এসব ব্যাংকের ভবিষ্যৎ। ২০১৩ সালে কার্যক্রমে আসা নতুন ৯টি ব্যাংক উল্লেখযোগ্য কোন মুনাফাও দেখাতে পারেনি। পুরনো ব্যাংকগুলো (মান ও ধরনভেদে) যেখানে হাজার কোটি টাকা মুনাফা করে সেখানে এসব ব্যাংকের অবস্থান অনেক নিচে। বিদায়ী বছরে সাউথ বাংলা এগ্রিকালচার অ্যান্ড কমার্স ব্যাংক ১৪, ইউনিয়ন ইসলামী ২৫, এনআরবি কমার্শিয়াল ১০, এনআরবি ২, মেঘনা সাড়ে ৬, ফারমার্স ৪, মিডল্যান্ড  ৪, মধুমতি ১০ কোটি টাকা পরিচালন মুনাফা করেছে। তবে এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংক এ সময়ে লাভ বা ক্ষতি কিছুই করতে পারেনি। এদিকে বাজার পরিস্থিতি বিশ্লেষণ না করে আমানত সংগ্রহ করেছে চতুর্থ প্রজন্মের এসব ব্যাংক। সেই আমানতই এখন তাদের জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিনিয়োগ করতে না পেরে বিপাকে পড়েছে ব্যাংকগুলো। কার্যক্রম শুরুর পর থেকেই ব্যাংকগুলো অন্য ব্যাংকের চেয়ে বেশি সুদে আমানত সংগ্রহের প্রতিযোগিতায় নামে। কম সুদে আমানত পেতে সরকারি আমানত গ্রহণের বাধাও তুলে নেয়ার অনুরোধ জানায়। গত বছরের ২২শে অক্টোবর অর্থ মন্ত্রণালয় এক প্রজ্ঞাপনে নতুন ব্যাংকগুলোয় তারল্য যোগানের লক্ষ্যে সরকারি আমানত রাখার সুযোগ করে দেয়া হয়। আগে নতুন ব্যাংক পাঁচ বছর পরিচালনা করার পর সরকারি আমানত গ্রহণের সুযোগ পেতো। ফলে এসব ব্যাংক কার্যক্রম শুরুর পরই আমানত পায়। তবে এর বিপরীতে বিনিয়োগ করতে পারেনি ব্যাংকগুলো। বিনিয়োগ থেকে আয় না হলেও আমানতকারীদের মুনাফা ঠিকই দিতে হচ্ছে তাদের। এ পরিস্থিতির জন্য মূলত দেশের রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতাকেই দায়ী করছেন ব্যাংকাররা। এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংকের চেয়ারম্যান ইঞ্জিনিয়ার ফরাছত আলী মানবজমিনকে জানান, মন্দা কাটিয়ে ওঠার পথে। এ পর্যন্ত ডিপোজিট ৭০০ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। তবে সংক্ষিপ্ত অতীত নিয়ে সন্তোষ না হলেও ভবিষ্যৎ নিয়ে ব্যাপক আশাবাদী তিনি। এ প্রসঙ্গে সাউথ বাংলা এগ্রিকালচার অ্যান্ড কমার্স ব্যাংকের (এসবিএসি) ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) রফিকুল ইসলাম বলেন, নতুন ব্যাংক হয়েও সরকারি ও বেসরকারি আমানতে আমরা ভাল সাড়া পেয়েছি। তবে পরিস্থিতির কারণে আশানুরূপ বিনিয়োগ করা যায়নি। বিনিয়োগ না হলেও আমানতের বিপরীতে মুনাফা তো দিতে হচ্ছে। তবে পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে আসায় বিনিয়োগ বাড়বে বলে আশা করছি। তথ্যমতে, ডিসেম্বরে বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলোর আমানতের গড় সুদহার ৮.৩৯% হলেও ঋণে গড় সুদহার দাঁড়িয়েছে ১৩.৪৫%। নতুন ব্যাংকগুলো প্রায় ১১ থেকে ১৫% সুদে আমানত নেয়। এর মধ্যে এনআরবি কমার্শিয়াল ১৪.৭৮, এসবিএসি ১৫.৪৮, মেঘনা ১৪.৩৪, মিডল্যান্ড ১৪.৯৬, ফারমার্স ১৫.০২, ইউনিয়ন ১৫.৩০, এনআরবি ১১.৫০ ও এনআরবি গ্লোবাল ১৪.১৫ এবং মধুমতি ১৩.৪০% সুদে আমানত সংগ্রহ করে। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ডিসেম্বরভিত্তিক হিসাবের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেন মধুমতি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. মিজানুর রহমান। তিনি মানবজমিনকে বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওই হিসাব ঠিক কি বেঠিক বলতে পারবো না। জানামতে ডিসেম্বরে মধুমতি সর্বোচ্চ ১২% সুদে আমানত সংগ্রহ করেছে। তিনি আরও বলেন, শুরুতে পলিটিক্যাল ক্রাইসিস থাকায় কিছুটা হোঁচট খেয়েছি। এখন তা সেরে ওঠার পথে। এ পর্যন্ত আমানত ৭৫০ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। ঋণ ৫০ কোটি টাকার মতো দেয়া হয়েছে। সুদের হার ১২ শতাংশ সীমায় রাখার সিদ্ধান্ত হয়েছে বলে জানান ব্যাংকটির এমডি মিজানুর রহমান। নতুন ব্যাংকের পরিচালন বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, এমন সময় যাত্রা করেছি, যখন পুরনো ব্যাংকগুলোই বিপাকে আছে। আমরাও শুরুতে বেশি সুদে আমানত সংগ্রহ করেছি। তবে বিনিয়োগ করতে না পারায় বিপাকে আছি। এ কারণে শুরুতেই লোকসান গুনতে হচ্ছে। পরিস্থিতির উন্নতি হলে আমানতের দিকে না ছুটে ঋণগ্রহীতার দিকে ঝুঁকতে হবে। পুরনো ব্যাংকগুলোর সঙ্গে প্রতিযোগিতায় না গিয়ে বিনিয়োগের জন্য নতুন নতুন খাত খুঁজতে হবে। এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংকের এমডি আবদুল কুদ্দুস বলেন, আমাদের আমানত কম, তাই বিনিয়োগ নিয়ে খুব বেশি বিপাকে পড়তে হয়নি। পরিচিত ব্যবসায়ী থাকায় আমানতের বড় অংশই বিনিয়োগের মধ্যে আছে।
নানা পক্ষের বাধার পরও সরকারদলীয় চাপে নতুন ৯টি ব্যাংকের অনুমোদন দিতে বাধ্য হয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ২০১২ সালের ১৭ই জুলাই অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিচালকদের এক বৈঠকে পরিচালকদের বেশির ভাগই নতুন ব্যাংকের অনুমতি দেয়ার বিপক্ষে কথা বলেন। তারপরও রাজনৈতিক চাপে নতুন ব্যাংক প্রতিষ্ঠায় আগ্রহী উদ্যোক্তাদের কাছ থেকে আবেদন চেয়ে একই বছরের ২৭শে সেপ্টেম্বর বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে কেন্দ্র্রীয় ব্যাংক। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ৩৭টি আবেদন জমা পড়ে। এর মধ্য থেকে যাচাই বাছাই করে ১৬টি আবেদন নিয়ে প্রাথমিক তালিকা করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এ আবেদনপত্রগুলোর উপর শুনানি শেষে ৯টি ব্যাংকের তালিকা পাঠানো হয় প্রধানমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রীর দপ্তরে। ২০১৩ সালের জানুয়ারিতে নতুন ৯টি ব্যাংকের লাইসেন্স ইস্যুর পরিকল্পনা নিয়ে কাজ শুরু করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ৫ই ফেব্রুয়ারি সব ধরনের শর্ত যাচাই করে চূড়ান্ত লাইসেন্সের বিষয়ে অনাপত্তিপত্র দেয় কেন্দ্র্রীয় ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ। কিন্তু কয়েকটি ব্যাংকের পরিশোধিত মূলধনের হিসাব ও কাগজপত্রে গরমিল, নিয়োগ বাণিজ্যসহ বিভিন্ন অভিযোগ থাকায় আবেদন করা ব্যাংকগুলোর প্রয়োজনীয় কাগজপত্র খতিয়ে দেখে অবশেষে ২০শে মার্চের পর থেকে লাইসেন্স দিতে শুরু করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এগুলো হচ্ছে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীরের ফারমার্স ব্যাংক, মহাজোট সরকারের তৎকালীন শরিক দল ও জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের ইউনিয়ন ব্যাংক, আওয়ামীপন্থি ব্যবসায়ী এসএম আমজাদ হোসেনের সাউথ বাংলা এগ্রিকালচার অ্যান্ড কমার্স ব্যাংক (এসবিএসি), প্রধানমন্ত্রীর আয়কর আইনজীবী ও কর্মসংস্থান ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান এম মনিরুজ্জামান খন্দকারের মিডল্যান্ড ব্যাংক, আওয়ামী লীগের রংপুর-৫ আসনের সংসদ সদস্য এইচ এন আশিকুর রহমানের মেঘনা ব্যাংক (এ ব্যাংকের অন্য উদ্যোক্তাদের মধ্যে অন্যতম ঢাকা-৩ আসনের সংসদ সদস্য নসরুল হামিদ বিপু), ঢাকা-১২ আসনের সংসদ সদস্য ফজলে নূর তাপসের মধুমতি ব্যাংক, যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগ নেতা, ইঞ্জিনিয়ার ফরাছত আলীর এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংক, যুক্তরাজ্য প্রবাসী ব্যবসায়ী ও সীমার্ক গ্রুপের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ইকবাল আহমেদের নন-রেসিডেন্ট ব্যাংক (এনআরবি) এবং যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগ নেতা নিজাম চৌধুরীর এনআরবি গ্লোবাল। 
সূত্র: দৈনিক মানবজমিন, ০৯ ফেব্রুয়ারী ২০১৪

,

0 comments

আপনার মন্তব্য লিখুন