হুমকির মুখে অর্থনীতি

রাজধানীর গুলশানের ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলার ঘটনায় বাংলাদেশের অর্থনীতি মারাত্মক হুমকির মুখে পড়বে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এ হামলার আগে থেকেই বিভিন্ন জঙ্গি-সংক্রান্ত হামলায় বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক বাংলাদেশ আশঙ্কায় ছিল। রাজনৈতিক অস্থিরতায় ভোগা দেশটি এ ঘটনায় আরও বিশৃঙ্খলার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে বলে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। অতীতে বাংলাদেশের ভাবমর্যাদায় সঙ্কট এলেও সরকার সুন্দরভাবে কাটিয়ে উঠেছে। তবে গুলশানের ঘটনা বাংলাদেশের জন্য একেবারে নতুন। এজন্য সরকারকে এখন থেকেই বায়ার ও বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে কথা বলে তাদেরকে আশ্বস্ত করতে হবে। একই সঙ্গে ব্যবসায়ী ও সরকারকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে এ সমস্যা মোকাবিলায় নতুন পরিকল্পনা নিয়ে এগোনোর কথা বলেছেন বিশেষজ্ঞরা। বিশ্বের অনেক দেশের পোশাক উৎপন্ন হয় বাংলাদেশে। আর তাই ইতোমধ্যে ঢাকার পরিস্থিতির দিকে নজর রাখছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও কূটনৈতিক মহল। এতে দেশের পোশাক শিল্প ও পর্যটন খাতে বড় ধরনের সংকট তৈরি হতে পরে বলে আশঙ্কা করছেন অর্থনীতিবীদ ও ব্যবসায়ীরা। তারা বলছেন, এই ধরনের ঘটনা সারা বিশ্বেই ঘটে। তবে বাংলাদেশে এটিই প্রথম। এতে করে আমাদের ব্যবসা-বাণিজ্যে এক ধরনের অস্থিরতা তৈরি হবে, যার বিরূপ প্রভাব আমাদের অর্থনীতিতে পড়বে। একই সঙ্গে বিদেশী নাগরিকদের মধ্যে নিরাপত্তাজনিত অনিশ্চয়তা দেখা দেবে, তারা দেশ ছেড়ে চলে যেতে পারে। এতে তাদের সঙ্গে এদেশের বিনিয়োগও অন্য দেশে চলে যাবে। ফলে বহির্বিশ্বে দীর্ঘমেয়াদে বাংলাদেশ ইমেজ সঙ্কটে পরবে। 

আমাদের জন্য নিরাপত্তাই এখন এক বড় চ্যালেঞ্জ। চ্যালেঞ্জ হচ্ছে নিরাপত্তা ব্যবস্থার প্রতি দেশের ভেতরে ও বাইরে আস্থা ফিরিয়ে আনা, এর কোনো বিকল্প নেই বলে মনে করছেন তারা। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, রেস্তোরাঁয় হামলার ঘটনা আমাদের অর্থনীতির জন্য একটি সতর্ক বার্তা। সরকারকে এখন থেকেই বায়ার ও বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে কথা বলে তাদেরকে আশ্বস্ত করতে হবে। এজন্য সরকারের দক্ষতা অনেক বাড়াতে হবে। সরকারকে অস্বীকার করার প্রবণতা থেকে বেরিয়ে এসে নিরাপত্তা খাত আরও শক্তিশালী করাসহ কূটনৈতিক তৎপরতা বাড়াতে হবে। পাশাপাশি এ ধরনের পরিস্থিতি মোকাবিলায় সবাইকে সম্মিলিতভাবে এগিয়ে আসতে হবে। দেশের প্রায় চার ভাগের এক ভাগ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে, তবুও প্রতিবছর ৬ শতাংশের উপরে প্রবৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। গত অর্থবছরে (২০১৫-১৬) যা ছিল ৭ দশমিক শূন্য ৫ শতাংশ। সদ্য শুরু হওয়া অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৭ দশমিক ২ শতাংশ। আর এর অন্যতম মাধ্যম গার্মেন্ট রপ্তানি, যেটি দেশের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি। গত বছরও মোট রপ্তানির ৮০ শতাংশই ছিল এ খাতের অবদান। পাশাপাশি এ খাতের হাজার হাজার কারখানায় কাজ করছেন প্রায় অর্ধ কোটি মানুষ। সন্ত্রাসী হামলার পর দেশের অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি গার্মেন্ট শিল্পের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কিত দেশের ব্যবসায়ীরা। গার্মেন্ট রপ্তানিকারকদের শীর্ষ সংগঠন বিজিএমইএ’র সিনিয়র সহ-সভাপতি ফারুক হাসান বলেন, এ হামলার দরুন বিদেশীরা মুখ ফিরিয়ে নেবে। এ শিল্পের জন্য এ হামলার প্রভাব হবে খুবই ক্ষতিকর। আমরা এখন দারুণভাবে উদ্বিগ্ন। ফারুক হাসানের নিজের প্রতিষ্ঠান জায়ান্ট গ্রুপ ব্রিটেনের মার্কস অ্যান্ড পন্সার ও নেক্সটসহ বহু রিটেইলারের জন্য পোশাক উৎপাদন করে। 

সুইডেনভিত্তিক বিশ্বখ্যাত পোশাক কো¤পানি এইচঅ্যান্ডএম বলেছে, এ বিয়োগান্তক হামলায় তারা গভীরভাবে ব্যথিত। এ কো¤পানির অনেক পোশাক উৎপন্ন হয় বাংলাদেশে। প্রতিষ্ঠানটির মুখপাত্র বোগ লিন্ড বলেন, আমরা অবশ্যই ঢাকার পরিস্থিতির দিকে ঘনিষ্ঠ নজর রাখছি। নিউ ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টার্ন সেন্টার ফর বিজনেস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস-এর কো-ডিরেক্টর সারা লাবোয়িটজ বলেন, ঢাকার জিম্মি সঙ্কট মারাত্মক বিয়োগান্তক ঘটনা। দেশটির নিরাপত্তা পরিস্থিতি কতটা খারাপ হয়েছে, তার প্রতিফলন এটি। লাবোয়িটজ আরও বলেন, বর্তমান সহিংসতার দরুন বাংলাদেশের অর্থনীতি মারাত্মক হুমকির মুখে। তার ভাষ্য, সামনের মাসগুলোতে ছুটির শপিং মৌসুম। আর এ ধরনের হামলার দরুন ক্রেতারা নিশ্চিতভাবে মুখ ফিরিয়ে নেবে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা মির্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, এ সন্ত্রাসী হামলায় বাংলাদেশ তার ইমেজ সংকটে পড়বে। আমাদের ব্যবসা-বাণিজ্যে এক ধরনের অস্থিরতা তৈরি হবে। বায়াররা ও বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশে বিনিয়োগে নিরুৎসাহী হবে। যেহেতু বাংলাদেশে বসবাসরত বিদেশিদের টার্গেট করে এই ধরনের সন্ত্রাসী কর্মকা- হচ্ছে, ফলে এ দেশে অবস্থানরত বিদেশিরা দেশ ত্যাগ করবে। যদি কেউ এখানে থেকে যায় তারা শঙ্কার মধ্যে জীবনযাপন করবে। শঙ্কায় থেকে তারা কখনো বিনিয়োগ করবে না। তিনি বলেন, অতীতে বাংলাদেশের ভাবমর্যাদায় সঙ্কট এলেও সরকার সুন্দরভাবে কাটিয়ে উঠেছে। তবে গুলশানের ঘটনা বাংলাদেশের জন্য একেবারে নতুন। এজন্য সরকারকে এখন থেকেই বায়ার ও বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে কথা বলে তাদেরকে আশ্বস্ত করতে হবে যে এটা একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা। এজন্য সরকার ও ব্যবসায়ীদের ঐক্যবদ্ধ হয়ে এ সমস্যা মোকাবিলা করতে হবে। ব্যবসায়ী ও সরকারকে নতুন পরিকল্পনা নিয়ে এগোতে হবে। 

পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ও অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মুনসুর বলেন, এই ঘটনায় আমাদের অর্থনীতিতে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদে বিরূপ প্রভাব পড়বে। অনেক বিদেশী এ দেশ থেকে চলে যেতে পারে। এতে তাদের সঙ্গে এদেশের বিনিয়োগও অন্য দেশে চলে যাবে, যার প্রভাব আমাদের অর্থনীতিতে পড়বে। পাশাপাশি আমাদের পর্যটন খাতে এ প্রভাব পড়বে। ইসলামাবাদে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের সাবেক প্রতিনিধি আহসান মনসুরের আশঙ্কা, বাণিজ্যনির্ভর বাংলাদেশকে হয়তো প্রতিদ্বন্দ্বী পাকিস্তানের মতো একই ভাগ্য বরণ করতে হবে। তিনি বলেন, আমি পাকিস্তানকে একটি সম্ভাবনাময় অর্থনীতি থেকে সন্ত্রাসের চারণক্ষেত্রে পরিণত হতে দেখেছি। এ হামলা আমাকে সেসব দিনের কথা মনে করিয়ে দেয়। তবুও আমি আশা করব পরিস্থিতি এমন মোড় নেবে না। তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশ একটি সম্ভাব্য সন্ত্রাসী হটস্পট, এমন ধারণা দেশের রপ্তানি সম্ভাবনা ও প্রবৃদ্ধিকে নিদারুণভাবে আঘাত করতে পারে। আহসান মনসুর বলেন, এ ঘটনা আমাদের পর্যটন খাত ও অর্থনীতির জন্য একটি সতর্ক বার্তা। এজন্য সরকারের দক্ষতা অনেক বাড়াতে হবে। সরকারকে অস্বীকার করার প্রবণতা থেকে বেরিয়ে এসে নিরাপত্তা খাত আরও শক্তিশালী করাসহ কূটনৈতিক তৎপরতা বাড়াতে হবে। পাশাপাশি এ ধরনের পরিস্থিতি মোকাবিলায় সবাইকে সম্মিলিতভাবে এগিয়ে আসতে হবে। তবে বাংলাদেশ বহু ঝড়ঝাপটা পেরিয়ে এখানে এসেছে। শ্রমিক অসন্তোষ, গণপরিবহন অবরোধ, ব্যাপক আকারে রাজনৈতিক অস্থিরতা ও কারখানা বিপর্যয়ের মধ্যেও টিকে আছে গার্মেন্ট শিল্প। এ বছরের জুনে বরং ১০ শতাংশ বেড়েছে পোশাক রপ্তানি। সিপিডির অতিরিক্ত গবেষণা পরিচালক তৌফিদুল ইসলাম খান বলেন, এ মুহূর্তে সারা বিশ্ব একটি চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। আর এ সময়ে বাংলাদেশে সন্ত্রাসী হামলা অর্থনীতিকে নতুন করে চ্যালেঞ্জের মুখে ঠেলে দেবে। গত কয়েক বছর আমাদের বিদেশি বিনিয়োগ খারাপ একটি পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এই ঘটনা বিনিয়োগকে আরও নিরুৎসাহিত করবে। এজন্য জঙ্গিবাদ-সন্ত্রাসবাদ নির্মূলে সরকারি ও বেসরকারিভাবে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করতে হবে। বিজিএমইএ’র সাবেক সভাপতি আব্দুস সালাম মুশের্দী বলেন, এ ধরনের ঘটনা আমাদের জন্য অপ্রত্যাশিত ও দুঃখজনক। গত তিন বছর বাংলাদেশের অর্থনীতি অনেক চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে পার করেছে। সবেমাত্র একটু ভালো দিকে যাচ্ছিল, আর ঠিক এ মুহূর্তে এ ধরনের ঘটনা বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমর্যাদায় প্রভাব ফেলবে। ফলে বায়াররা বাংলাদেশ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে। যেসব বিনিয়োগকারী বিনিয়োগ নিয়ে আসতে চেয়েছিল তারা এখন ১০ বার ভাববে। 

সবচেয়ে বড় কথা হলো বাংলাদেশের অর্থনীতিতে একটা বড় ধরনের ধাক্কা আসবে। এফবিসিসিআই সহ-সভাপতি মাহবুবুল আলম বলেন, যে কোনো দুর্ঘটনাই অর্থনীতির জন্য ক্ষতিকর। এ ধরনের ঘটনা মোটেও সুখকর নয়। এতে অর্থনৈতিক কী পরিমাণ ক্ষতির সম্মুুখীন হতে হবে, এ মুহূর্তে হিসাব করা সম্ভব হবে না। আগামী চার থেকে পাঁচ মাস পরে এটা বোঝা যাবে। আগামীতে যাতে এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি না ঘটে তার জন্য সবাইকে একত্রে কাজ করতে হবে। এদিকে বিদেশী রিটেইলাররা বাংলাদেশের দিকে ঘনিষ্ঠভাবে নজর রাখছে। যদিও এ শিল্পের অনেক বিশেষজ্ঞের যুক্তিÑশুধু বাংলাদেশই নয়; সস্তা শ্রমিক পাওয়া যায়, এমন অনেক উন্নয়নশীল দেশেই সন্ত্রাসবাদসংশ্লিষ্ট অস্থিরতা দানা বেঁধেছে। গত বছর থেকে ফ্রান্স, বেলজিয়াম ও যুক্তরাষ্ট্রে সন্ত্রাসী হামলা প্রমাণ করে, শুধু উন্নয়নশীল দেশেই সীমাবদ্ধ নেই চরমপন্থী সহিংসতার ঝুঁকি। নয়াদিল্লিভিত্তিক রিটেইল পরামর্শক প্রতিষ্ঠান থার্ড আইসাইটের প্রধান নির্বাহী দেভাংশু দত্ত তাদেরই একজন। তিনি বলেন, যদি ভয়ের কাছে নতি স্বীকার করেন বিদেশীরা, সন্ত্রাসীদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিল হয়ে যাবে। বিপুল পরিমাণ দারিদ্র্য উপদ্রুত জনসংখ্যার উন্নতির জন্য রপ্তানি ও বিদেশী বিনিয়োগ খুবই প্রয়োজন। তিনি আরও বলেন, বিদেশীদের অবদান খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সবারই জড়িত থাকাটা গুরুত্বপূর্ণ।(সূত্র: দৈনিক ইনকিলাব, ১১/ ০৭/ ২০১৬)

, ,

0 comments

আপনার মন্তব্য লিখুন