দেশের ব্যাংকিং ব্যবসা ছয় এলাকায় কেন্দ্রীভূত

শহরকেন্দ্রিক ছয় এলাকার মধ্যে সীমিত হয়ে পড়েছে ব্যাংকের ব্যবসা। মোট আমানতের ৪৩ শতাংশই আসছে রাজধানীর চারটি ও চট্টগ্রামের দুটি এলাকার শাখা থেকে। একই চিত্র বিনিয়োগের ক্ষেত্রেও। যদিও বিকেন্দ্রীকরণের অংশ হিসেবে পল্লী অঞ্চলে ব্যাংক শাখা সম্প্রসারণ করা হচ্ছে। তার পরও মুনাফার জন্য শহরের ওপরই নির্ভর করতে হচ্ছে ব্যাংকগুলোকে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, ২০১৩ সালের জুনভিত্তিক হিসাবে মোট আমানতে মতিঝিল অঞ্চলের অবদান ছিল ১৮ দশমিক ৬৫ শতাংশ। এ সময়ে রাজধানীর অন্য তিন এলাকা গুলশান, ধানমন্ডি ও রমনার অবদান যথাক্রমে ৮ দশমিক ৭৮, ৫ দশমিক ৩৩ ও ৩ দশমিক ৪৫ শতাংশ। চট্টগ্রামের ডবলমুরিং ও কোতোয়ালি এলাকার অবদান এক্ষেত্রে ৩ দশমিক ৭৭ ও ৩ দশমিক ৩৯ শতাংশ। আমানতের মতো বিনিয়োগও সীমিত হয়ে পড়েছে শহরভিত্তিক ছয় এলাকার মধ্যে। ২০১৩ সালের জুনভিত্তিক হিসাবে এসব এলাকার শাখা থেকে বিতরণ হয়েছে মোট ঋণের ৬২ দশমিক ৬১ শতাংশ। এর মধ্যে মতিঝিল, গুলশান, ধানমন্ডি ও রমনা এলাকা থেকে বিতরণ হয়েছে যথাক্রমে ২৯ দশমিক ২৬, ১১ দশমিক ৬, ৪ দশমিক শূন্য ৪ ও ২ দশমিক ৯৪ শতাংশ। চট্টগ্রামের কোতোয়ালি ও ডবলমুরিং থেকে এ সময় বিতরণ হয়েছে মোট ঋণের ৭ দশমিক ৭ ও ৭ দশমিক শূন্য ৭ শতাংশ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ এ প্রসঙ্গে বণিক বার্তাকে বলেন, যারা পরিচিত, তারাই ঋণ পাচ্ছে। এ কারণেই এমনটা হচ্ছে। দেশের সুষম উন্নয়নের জন্য কিছু এলাকা ও ব্যবসায়ীর কাছে                 ঋণ কেন্দ্রীভূত হয়ে পড়াটা কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না।                আর্থিক অন্তর্ভুক্তির উদ্দেশ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংক হিসাব খোলার ব্যবস্থা করলেও তা দিয়ে সুষম উন্নয়ন হবে না। ব্যাংক ব্যবসা বিকেন্দ্রীকরণে নতুন    উদ্যোগ নিতে হবে। বর্তমানে যা চলছে, তা ব্যাংকের জন্য ভালো             নয়।
গত কয়েক বছরের আমানত সংগ্রহের তথ্য বিশ্লেষণেও ব্যাংক ব্যবসায় শহরকেন্দ্রিক কয়েকটি এলাকার ব্যাংক শাখার আধিপত্যের চিত্র উঠে এসেছে। জুনভিত্তিক হিসাবে ২০০৯ সালে মোট আমানতে মতিঝিলের অবদান ছিল ১৯ দশমিক ৫১, ২০১০ সালে ২০ দশমিক ৫, ২০১১ সালে ১৯ দশমিক ৮৮ ও ২০১২ সালে ১৯ শতাংশ। একই সময়ে গুলশানের অবদান ছিল যথাক্রমে ৮ দশমিক ৩২, ৮ দশমিক ২৬, ৮ দশমিক ৫১ ও ৮ দশমিক ৭৮ শতাংশ। এক্ষেত্রে ধানমন্ডি এলাকার অবদান ছিল যথাক্রমে ৬ দশমিক ২৭, ৫ দশমিক ৯৮, ৫ দশমিক ৯৩ ও ৫ দশমিক ৫৭ শতাংশ। একইভাবে অবদান রেখেছে চট্টগ্রামের কোতোয়ালি, ডবলমুরিং ও রাজধানীর রমনা এলাকাও।
অধিকসংখ্যক মানুষকে ব্যাংকিং সেবার আওতায় আনতে ২০১১ সালের ২২ ডিসেম্বর নতুন নীতিমালা প্রণয়ন করে বাংলাদেশ ব্যাংক। তাতে বলা হয়, এখন থেকে শহর ও পল্লীতে ব্যাংক শাখার অনুপাত হবে ১ ঃ ১। সিটি করপোরেশন ও সব ধরনের পৌরসভার শাখা শহর শাখা হিসেবে বিবেচিত হবে। পাশাপাশি কোনো শহরতলি নতুন করে সিটি করপোরেশন বা পৌরসভার অন্তর্ভুক্ত হলে সেখানকার শাখাও শহর শাখা হিসেবে গণ্য হবে। নতুন কোনো পৌরসভা সৃষ্টি হলে সেখানকার শাখাও শহর শাখা হিসেবে গণ্য হবে। নতুন ব্যাংকের লাইসেন্স দেয়ার ক্ষেত্রেও অন্যতম শর্ত ছিল শহর ও পল্লীতে সমানসংখ্যক শাখা খোলা।
এ নির্দেশনার পর বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলো পল্লী অঞ্চলে শাখা বাড়াতে উদ্যোগী হয়। তবে পল্লী এলাকায় ব্যবসা সম্প্রসারণের গতি মন্থর হওয়ায় ব্যাংকগুলো সুবিধা করতে পারেনি। ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প (এসএমই) খাত দিয়েই টিকে আছে ওই সব শাখা। এসব শাখায় পদায়ন নিয়েও ঝামেলায় পড়তে হয় ব্যাংকগুলোকে। বেশির ভাগ ব্যাংক কর্মকর্তাই পল্লী অঞ্চলে যেতে আগ্রহী হননি। পল্লী শাখায় পদায়নের পর সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন, এমন নজিরও রয়েছে। ফলে বছরজুড়েই ব্যাংকগুলোর মানবসম্পদ বিভাগকে পল্লী শাখার জনবল নিয়ে ব্যস্ত থাকতে হচ্ছে।
ব্যাংক নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) চেয়ারম্যান ও ইস্টার্ন ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আলী রেজা ইফতেখার এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘নিয়মের কারণেই পল্লী অঞ্চলে শাখা খুলতে হচ্ছে আমাদের। তবে শহরের মতো পল্লীতে তেমন ব্যবসা সম্প্রসারণ না হওয়ায় শাখাগুলোও মুনাফায় যেতে সময় নিচ্ছে। মুনাফার ক্ষেত্রে শহর ও পল্লী শাখার মধ্যে সমন্বয় করে এগোতে হচ্ছে। কারণ শেয়ারহোল্ডারদের বিষয়টি বিবেচনায় রেখে ব্যাংকগুলোকে মুনাফার বিষয়টি ভাবতে হয়।’
রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ও বিশেষায়িত কৃষি ব্যাংকের কারণে সামগ্রিকভাবে অর্ধেকের বেশি শাখা এখনো পল্লী অঞ্চলে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাবে, ২০১২ সালে শহরে ব্যাংক শাখার হার ছিল ৪২ দশমিক ৮ শতাংশ। ২০০৯ সালে এ হার ছিল ৪২ দশমিক ৪৫, ২০১০ সালে ৪২ দশমিক ৬৪ ও ২০১১ সালে ৪২ দশমিক ৮৩ শতাংশ।
বেসরকারি ব্যাংকের শাখা গ্রামাঞ্চলে আগে কম থাকলেও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনার পর তা বাড়তে শুরু করেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, ২০১৩ সালে বেসরকারি ব্যাংকের পল্লী শাখার হার ৪০ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। যদিও ২০০৯ সালে এ হার ছিল ৩৩, ২০১০ সালে ৩৬, ২০১১ সালে ৩৭ ও ১২ সালে ৩৯ শতাংশ।
একাধিক ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীরা জানান, পল্লীতে শাখা খোলার ফলে ব্যাংকের মুনাফা কমে যাচ্ছে। শহর শাখার মুনাফা দিয়ে পল্লী শাখাগুলো পরিচালনা করতে হচ্ছে। এছাড়া কর্মকর্তারাও এসব শাখায় যেতে চান না। এ নিয়ে প্রতিনিয়ত সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে। হিসাব খোলার মতো কিছু কর্মকাণ্ড চললেও গ্রামাঞ্চলের অনেক শাখায়ই বাস্তবে তেমন কোনো কাজ হচ্ছে না।
আর্থিক খাত বিশ্লেষক মামুন রশীদ এ প্রসঙ্গে বলেন, ব্যাংকগুলো এখনো পল্লীতে শাখা খোলার ব্যাপারে তেমন একটা আগ্রহী নয়। বাধ্য হয়ে কোনো রকমে শাখা খুলে রাখছে। এজন্য যে পরিমাণ বিনিয়োগ ও যোগ্য লোক নিয়োগ দেয়া প্রয়োজন তা হচ্ছে না। এছাড়া সুদের হার কম ও সহজলভ্য হওয়ায় বেসরকারি ব্যাংকের চেয়ে সরকারি ব্যাংক ও এনজিওকেই বেশি প্রাধান্য দেন পল্লীবাসী।
সূত্র: দৈনিক বণিকবার্তা, ০৯ ফেব্রুয়ারী ২০১৪

,

0 comments

আপনার মন্তব্য লিখুন