বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ হুমকির মুখে- দেব মুখার্জি

বাংলাদেশে ৫ই জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হয়েছে জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এর ফলও ঘোষণা করা হয়েছে। তবে অল্প কয়েকটি আসন বাকি রয়েছে। সেখানে পরে নির্বাচন দেয়া হবে। অপ্রত্যাশিত সহিংসতার ধারাবাহিকতার মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠিত এ নির্বাচন বর্জন করেছে বাংলাদেশের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি। দলের গঠনতন্ত্র সংবিধান অনুসরণ করে না বলে আদালতের একটি আদেশে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারে নি জামায়াতে ইসলামী। যেমনটা ধারণা করা হয়েছিল যে বেশির ভাগ আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়ে ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাচ্ছে আওয়ামী লীগ। এর আগের পূর্ণাঙ্গ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ যে আসন পেয়েছিল এবারকার আসন তার কাছাকাছি। জাতীয় সংসদের ৩০০ আসনের মধ্যে তারা ২৩০ আসনে বিজয়ী হয়েছে। নির্বাচন সমর্থন করে অন্য যেসব দল নির্বাচন করেছে তারা বাকি আসনগুলোতে বিজয়ী হয়েছে। ভোটারদের উদাসীনতা, সহিংসতা, নির্বাচনী কর্মকর্তাদের হুমকি দেয়া হয়। বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর সমর্থকরা যে হুমকি দিয়ে যাচ্ছিল তাতে খুব কম ভোটার ভোট দিয়েছেন। পশ্চিমা মিডিয়ার খবর অনুযায়ী, সকালে ভোটকেন্দ্রে হামলার খবরের পর অনেক ভোটার ভোট দিতে যান নি।
সরকার (আওয়ামী লীগ) ও বিরোধী দল (বিএনপি)-এর প্রতিনিধিদের মধ্যে থেমে থেমে আলোচনার পর আসে এ নির্বাচন। মোদ্দা কথা হলো, নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন দাবি করে বিএনপি, যেমন নির্বাচন হয়েছে কয়েকবার। কিন্তু সরকার বলে, সংশোধিত সংবিধানের পক্ষে তারা। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা মেনে নেয়া সম্ভব নয়। তাই আইনের আওতায় অনুষ্ঠিত হয়েছে নির্বাচন। বিরোধী দলের অংশগ্রহণ না থাকায় ভোটাররা ভোট দেয়া থেকে বিরত থাকে। এর ফলে নির্বাচন প্রক্রিয়ার বিশ্বাসযোগ্যতার ওপর ছায়া ফেলেছে।
সামপ্রতিক সময়ে আলাদা দু’টি ইস্যুতে বাংলাদেশ গত কয়েক মাস ছিল সবচেয়ে সহিংস। ১৯৯৬ এবং ২০০৬-০৭ সময়ে যে নির্বাচন হয়েছে তাতেও ছিল মতপার্থক্য। এখন নির্বাচন অনুষ্ঠানের পদ্ধতি ছাড়াও ২০১৩ সালের বসন্তে শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলনের পর থেকে যুদ্ধাপরাধের বিচার নিয়ে বাংলাদেশ রয়েছে উত্তেজিত অবস্থায়। সারা দেশে ব্যাপক সহিংসতা ও স্যাবোটাজ চালাচ্ছে জামায়াতে ইসলামীর সমর্থকরা। তাদের নেতা আবদুল কাদের মোল্লাকে স্বাধীনতাযুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে ফাঁসি দেয়া হয়েছে। এ অপরাধে তাকেই প্রথম ফাঁসি দেয়া হলো। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে মধ্য ডিসেম্বরে উত্তেজনা আরও বৃদ্ধি পায়। প্রথম দিকে বিএনপি যখন হরতাল, অবরোধ আহ্বান করে তখন জামায়াত কর্মীরা ব্যাপকভাবে সহিংসতা চালায়। বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামের মধ্যে সম্পর্ক ক্রমাগত গাঢ় হচ্ছে।
গত বছর বাংলাদেশে মেয়র নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এতে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থীদের পরাজিত করে বিজয় অর্জন করে বিএনপি। আইনশৃঙ্খলা ও অর্থনীতির মতো মৌলিক নির্ণায়কগুলোতে বিগত বছরগুলোতে সরকার ভাল করার রেকর্ড থাকা সত্ত্বেও দুর্নীতির অভিযোগ, জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার অভিযোগ ভোটারদের নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় বিএনপির পাশে এসে দাঁড়াতে উদ্বুদ্ধ করেছে।
এমন দৃষ্টিভঙ্গিতে, বিজয় দৃশ্যত সুনিশ্চিত জেনেও বিএনপি সরকারের সঙ্গে আলোচনার ক্ষেত্রে একরোখা ও অনড় অবস্থান নিয়েছে- এটা আশ্চর্যজনক। যদিও রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনের ফল তাদের পক্ষে না গেলে কারচুপির অভিযোগ আনে এবং এটা এক রকম রীতিতে পরিণত হয়েছে, তা সত্ত্বেও প্রকৃত সত্য হলো ১৯৯৬ (জুনে), ২০০১ ও ২০০৮ সালের নির্বাচন ব্যাপক অর্থে অবাধ ও সুষ্ঠু বলে গৃহীত হয়েছে। এসব নির্বাচন যে ভিন্ন কিছু ছিল তা বিশ্বাস না করার কোন কারণই নেই। বাংলাদেশের সার্বিক রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে এটা এমন একটি নির্বাচন ছিল, যাতে বিএনপি বিজয়ী হতেই চায় নি। যুদ্ধাপরাধের বিচার ও বিশেষ করে যুদ্ধাপরাধের দায়ে দোষীদের শাস্তির দাবিতে শাহবাগ আন্দোলনের পর ক্ষমতাসীনরা যাতে এ বিচার চালিয়ে নিতে পারে আইনগতভাবে তাতে সমর্থন দিতে পারতো বিএনপি। শীর্ষ অনেক নেতা ও মিত্র জামায়াতে ইসলামের কাছে এ বিষয়টি ছিল অগ্রহণযোগ্য। 
অন্যদিকে, এ বিচার প্রক্রিয়াকে বিঘ্নিত করা ছিল পাবলিক সেন্টিমেন্টের তীব্র বিরোধী। তারা যে স্বাধীনতাযুদ্ধের সময়কার হত্যা ও নৃশংসতার অভিযোগে অভিযুক্তদের জন্য নমনীয় এমনটা ধরা পড়ে। বিএনপি এখন যুদ্ধাপরাধ ইস্যুতে একটি অবস্থান নিতে পারে এবং এ ইস্যুতে তাদের অবস্থান পরিষ্কার করতে পারে। যখন তারা সরকারকে অগণতান্ত্রিক আখ্যায়িত করছে সেখানে এ ইস্যুটির পরিসমাপ্তি পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।
বিএনপি একটি প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দল। এ দল দু’বার নির্বাচিত হয়ে সরকার গঠন করেছে। গণতন্ত্র পুনঃপ্রবর্তনের পর থেকে বিএনপি ও আওয়ামী লীগকে পর্যায়ক্রমে দেখা গেছে নির্বাচিত হতে। মূল কথা হলো, বাংলাদেশের চেতনার আবশ্যিকতার সঙ্গে তারা কতটা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ তা নিয়ে কখনও গুরুত্ব দিয়ে প্রশ্ন তোলা হয় নি। সমপ্রতি তারা প্রকাশ্যে জামায়াতের সঙ্গে জোট গড়েছে। এই জামায়াত ১৯৭১ সালের স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় তাদের ভূমিকার জন্য অনুশোচনা করে না এখনও এবং তারা এখনও একটি ইসলামী সমাজ কায়েম করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। সমপ্রতি পাকিস্তানের পার্লামেন্ট জামায়াত নেতা আবদুল কাদের মোল্লার ফাঁসি দেয়ার ঘটনায় দুঃখ ও উদ্বেগ প্রকাশ করে প্রস্তাব পাস করেছে। তারা কাদের মোল্লাকে পাকিস্তানের একজন দেশপ্রেমিক হিসেবে দেখে। এখন জনগণের কাছে এ বিষয়টি বিএনপি কিভাবে উপস্থাপনা করবে তা দেখার বিষয়। ভালভাবে জানা গেছে, বিএনপির অনেক নেতা এ ঘটনায় অস্বস্তিতে আছেন। ওদিকে চিকিৎসার জন্য লন্ডনে অবস্থান করছেন বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান ও পার্টির প্রধান বেগম খালেদা জিয়ার ছেলে তারেক রহমান। তিনি সেখান থেকে যে বার্তা দিচ্ছেন তা পরিস্থিতিতে বিঘ্ন সৃষ্টি করছে। তিনি জোর দিয়ে রাজনীতিতে সংঘাতের পরামর্শ দিচ্ছেন। তিনি সর্বশেষ যে বার্তা দিয়েছেন তাতে তিনি বলেছেন, ১৯৭২ সালের সংবিধানে জনগণের সমর্থন নেই। এতে দলটির উদ্দেশ্য নিয়ে অস্বস্তিকর কিছু প্রশ্ন এসে যায়। এর ফলে একজন সুপরিচিত বিশ্লেষক মন্তব্য করেন, ‘যখন একটি দল বিচারবুদ্ধি হারিয়ে ফেলে...’। ১৯৭২ সালের সংবিধান এখনও রাষ্ট্রের ভিত্তি। যদিও এতে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ও হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ঘষামাজা করেছেন এবং বিচার বিভাগ পরে তা ঠিকঠাক করেছে।
২০০১ সালে নির্বাচন-পরবর্তী সময়ের মতো হিন্দু সমপ্রদায়কে জামায়াত ও বিএনপির সমর্থকরা অনেক এলাকায় টার্গেট করে। আগে এ রকম ইতস্তত ঘটনায় ব্যাপক মাত্রা পেতো এবং তা নিয়ে মিডিয়ায় ব্যাপক প্রচার পেতো। তাতে বলা হতো সরকার নিরাপত্তা দিতে অক্ষম।  বাংলাদেশের মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান বলেছেন, নির্বাচন-পরবর্তী সহিংসতা মোকাবিলায় রাষ্ট্রের যে কোন ধরনের শক্তি ব্যবহার প্রয়োজন তা করতে হবে। এর মাধ্যমে রাষ্ট্র ও ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্র রক্ষা করতে হবে।
নির্বাচন নিয়ে সবচেয়ে কড়া সমালোচনা এসেছে যুক্তরাষ্ট্র থেকে। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা অর্জনের সময় থেকে তারা বাংলাদেশ বিষয়ে সঠিক রায় দেয় নি বলে পরিচিতি আছে এবং আওয়ামী লীগ তাদের বিদ্বেষের পাত্রে পরিণত হয়েছে। আমি যখন ঢাকায় ছিলাম তখনকার কথা স্মরণ করতে পারি। সেটা ছিল ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাস। তখন বিএনপি একটি নির্বাচন করে। যুক্তরাষ্ট্র তখন তাদের সমর্থন দিয়েছিল। বলেছিল, এ নির্বাচন সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা ছিল। কিন্তু এবার তার উল্টো কথা বলছে তারা। জাতিসংঘের মহাসচিব, কমনওয়েলথ ভারসাম্য রেখে কথা বলেছেন। তারা রাজনীতিতে সহিংসতাকে অগ্রহণযোগ্য বলে জোর মন্তব্য দিয়েছেন।
রাশিয়া ও চীনের মতো বড় শক্তিগুলো তাদের পরামর্শ দিয়েছে। নির্বাচনকে সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা বলে মন্তব্য করেছে ভারত। সঙ্গে সঙ্গে বলেছে, সামনে এগোনোর পথ হতে পারে না এবং হওয়া উচিত নয় সহিংসতা। এটা যথার্থ যে, ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সালমান খুরশিদ বলেছেন, বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্র অনেক দূরে। কিন্তু ভারত তার একেবারেই প্রতিবেশী। তাই এ অঞ্চল সম্পর্কে এবং এ অঞ্চলের জনগণের সেন্টিমেন্ট সম্পর্কে আমরা যা জানি তা তাদের অবস্থান নেয়ার ক্ষেত্রে সহায়ক হবে। চারদিকে রাজনীতির ঝড়ো হাওয়া। এ অবস্থায় সরকারের প্রথম কাজ হওয়া উচিত কঠোরভাবে আইনশৃঙ্খলা পুনঃপ্রতিষ্ঠা, যা তারা গত কয়েক মাসে কার্যকরভাবে করে নি। এতে অনেক নিরপরাধ মানুষ নিহত হয়েছেন প্রতিদিন। রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি ধ্বংস করা হয়েছে। আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব থেকে বিবৃতিতে ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে, তারা সচেতন ছিলেন যে আইনগতভাবে নির্বাচন হতে হবে। তারা আরও জানতেন, যে কোন বিরোধীর অনুপস্থিতিতে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন থাকবে। আইনগতভাবে এ নির্বাচন বৈধ বলে নতুন সরকারের পূর্ণাঙ্গ মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে আরেকটি নির্বাচনের জন্য সমঝোতার প্রস্তাব যথাযথ নয়। কিন্তু তা করতে হলে দু’পক্ষকেই গিভ অ্যান্ড টেক-এর মানসিকতা নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। পরিষ্কারভাবে বলা যায়, লন্ডন থেকে বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান সংঘাতের যে আহ্বান জানিয়েছেন এমন আহ্বানের কোন পথ নেই। বিএনপিকে মূল্যায়ন করতে হবে, জামায়াতের সঙ্গে তাদের যে সখ্য তা বাংলাদেশের জন্য এমনকি রাজনীতির জন্য শুভকর কিনা। বাংলাদেশের রাজনীতির ভবিষ্যৎ হুমকির মুখে। এমন অবস্থায় আওয়ামী লীগ নিজেকে ১৯৭১ সালের স্বাধীনতাযুদ্ধের চেতনার একমাত্র রক্ষক হিসেবে তুলে ধরতে না-ও পারে। তখন দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে সচেতন এমন নাগরিকদের একটি বড় অংশের সমর্থন পেতে পারেন তারা।
দেব মুখার্জি : নেপাল ও বাংলাদেশে ভারতীয় সাবেক হাইকমিশনার।
(গতকাল ভারতের দ্য টেলিগ্রাফ পত্রিকায় প্রকাশিত ‘ইলেকশনস অ্যান্ড আফটার: দি আওয়ামী লীগ ইজ নট দ্য সোল কাস্টডিয়ান অব দ্য ১৯৭১ স্পিরিট’ শীর্ষক লেখার অনুবাদ)

,

0 comments

আপনার মন্তব্য লিখুন