জঙ্গি দমনে কাজ করছে ১৭ সরকারি প্রতিষ্ঠান

আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের পাশাপাশি জঙ্গি দমনে একযোগে মাঠে নেমেছে সরকারি ১৭টি প্রতিষ্ঠান। সরকারের নির্দেশে গত সপ্তাহ থেকে জঙ্গি অর্থায়নের উৎস খুঁজে বের করাসহ আলাদা মনিটরিং সেল গঠনের মাধ্যমে কাজ করছে বাংলাদেশ ব্যাংক, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, শিক্ষা মন্ত্রণালয়, তথ্য মন্ত্রণালয়, সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়, ধর্ম মন্ত্রণালয়, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, পুলিশ, র‌্যাব এবং বিজিবিসহ কয়েকটি গোয়েন্দা সংস্থা। ইতোমধ্যে এসব প্রতিষ্ঠানের সদস্যরা দেশের বিভিন্ন এলাকায় মাঠ পর্যায়ে কাজ শুরু করেছে বলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের গঠিত জঙ্গিবাদ প্রতিরোধ ও প্রতিকার বিষয়ক জাতীয় কমিটি সূত্রে জানা গেছে।
ওদিকে, জঙ্গি দমনের পাশাপশি একাধিক ইসলামী সমমনা রাজনৈতিক দলের ওপর নজরদারি করছে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। প্রায় সাড়ে ৫ হাজার মসজিদ-মাদ্রাসার ওপর নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। নতুন করে জঙ্গিবাদের উত্থান হতে পারে_ এমন আশঙ্কায় ঝুঁকিপূর্ণ ১৪টি জেলায় বিশেষ গোয়েন্দা তৎপরতা বাড়ানো হয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় গত কয়েকদিনে দেশি-বিদেশি জঙ্গি সংগঠনের সদস্যদের আইনের আওতায় আনা সম্ভব হয়েছে বলে র‌্যাব-পুলিশ দাবি করেছে। এ সময় গ্রেপ্তার করা হয়েছে নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠনগুলোর নেতৃত্ব পর্যায়ের নেতাকর্মীদের।
এ সম্পর্কে পুলিশপ্রধান হাসান মাহমুদ খন্দকার শনিবার সন্ধ্যায় যায়যায়দিনকে জানান, দেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে জঙ্গিবাদ দমন করা সম্ভব হয়েছে। তারপরও নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠনের সদস্যরা ধরা পড়ছে। এর মধ্যে বিদেশি জঙ্গি সংগঠনের সদস্যরাও রয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে আরো কঠের পদক্ষেপ নেয়া হবে। আগামীতে যেন এসব জঙ্গি সংগঠনের সদস্যরা কোনোভাবেই দেশে প্রবেশ করতে না পারে, সেজন্য ইতোমধ্যে সংশ্লিষ্ট সবাইকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
তিনি আরো জানান, জঙ্গি দমনে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে একটি জাতীয় কমিটি গঠন করা হয়েছে। এই কমিটিতে রাষ্ট্রায়ত্ত ১৭টি প্রতিষ্ঠানের সদস্য রয়েছে। কমিটিতে বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরাও রয়েছে। তারা জঙ্গি দমনে পুলিশ ও র‌্যাবকে তথ্য দিয়ে সহায়তা করবে। দেশবাসীসহ সবার সহযোগিতা পেলে জঙ্গিবাদকে সমূলে উৎপাটন করা সম্ভব হবে বলে আশা প্রকাশ করেছেন পুলিশপ্রধান হাসান মাহমুদ খন্দকার। পাশাপাশি ইসলামী দলের ব্যনারে কেউ যেন জঙ্গিবাদের উত্থান ঘটাতে না পারে, সেদিকেও লক্ষ রাখা হচ্ছে। সব মিলিয়ে দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি সরকারের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে বলে জানান তিনি।
জানা গেছে, ২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে বর্তমান সরকার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে জঙ্গিবাদ প্রতিরোধ ও প্রতিকার বিষয়ক জাতীয় কমিটি গঠন করলেও কার্যত বিগত বছরগুলোতে তাদের কার্যক্রম চোখে পড়েনি। এ অবস্থায় বর্তমান সরকার নতুনভাবে দায়িত্ব নেয়ার পর এই কমিটিকে কার্যক্রম জোরদার করার নির্দেশ দেয়। মূলত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে-পরে সংঘটিত তা-বের সঙ্গে জড়িত জামায়াতে ইসলামীর অপতৎপরতা দমনের জন্যই সরকার আবারো নতুন করে এই পদক্ষেপ নিয়েছে।
র‌্যাবের এডিজি কর্নেল জিয়াউল আহসান যায়যায়দিনকে জানান, জঙ্গি সংগঠনগুলোর কাজ হচ্ছে ঘাপটি মেরে থেকে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের ওপর হামলা চালানো, দেশের ইমেজ নষ্ট করার জন্য বিভিন্ন ধরনের অপপ্রচার চালানো। এছাড়া তারা রাষ্ট্রদ্রোহিতামূলক কার্যকলাপেও যুক্ত থাকে। সম্প্রতি দেশের অভ্যন্তরে তাদের তৎপরতা চোখে না পড়লেও কিছু নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠনের সদস্যদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এ সময় তাদের কাছ থেকে সরকার ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উস্কানিমূলক লিফলেট উদ্ধার করা হয়েছে। তবে র‌্যাবের পক্ষ থেকে জঙ্গি সংগঠনগুলোর প্রতি আলাদা বিশেষ নজরদারি অব্যাহত রয়েছে। কোথাও তাদের তৎপরতা দেখা গেলে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেয়া হবে। বর্তমানে জামায়াত-শিবিরের সদস্যরা অনেকটা জঙ্গিদের মতোই আচরণ করছে বলে জানিয়েছেন র‌্যাবের এই চৌকস কর্মকর্তা।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় গঠিত জঙ্গিবাদ প্রতিরোধ ও প্রতিকার বিষয়ক জাতীয় কমিটি সূত্রে জানা গেছে, নির্বাচনী ইশতেহার অনুযায়ী জঙ্গিবাদের উত্থান এবং সমূলে উৎপাটনকে অন্যতম কাজ হিসেবে নিয়েছে সরকার। এজন্য সরকার গঠনের পর অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সরকারি ১৭টি প্রতিষ্ঠানকে এ সংক্রান্ত কঠোর নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। নির্দেশপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, শিক্ষা মন্ত্রণালয়, তথ্য মন্ত্রণালয়, সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়, ধর্ম মন্ত্রণালয়, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, পুলিশ, র‌্যাব এবং বিজিবিসহ কয়েকটি গোয়েন্দা সংস্থা। সার্বিক অনুসন্ধান ত্বরান্বিত করতে জঙ্গিবাদ প্রতিরোধ ও প্রতিকার বিষয়ক জাতীয় কমিটির সুপারিশে বরাদ্দকৃত অর্থ দ্বিগুণ করা হচ্ছে। অত্যাধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর করা হচ্ছে মনিটরিং কার্যক্রম। কমিটির কার্যক্রম তদারকি করতে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালকে ১৭ সদস্যবিশিষ্ট সেলের প্রধান করা হচ্ছে।
সূত্র মতে, সরকারের নির্দেশের পরই জঙ্গিদের সহায়তায় পাঠানো অর্থের উৎস খুঁজতে শুরু করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। যদিও অনেক আগে থেকেই বাংলাদেশ ব্যাংক এ বিষয়ে কাজ করছিল, কিন্তু এই নির্দেশনা পাওয়ার পর তারা আরো বেশি তৎপর হয়েছে। এছাড়া কমিটির অন্য সদস্যরা কাজ শুরু করেছেন। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে সন্দেহভাজন বিদেশ থেকে অর্থ পাঠানো ব্যক্তিদের সম্পর্কে খোঁজ-খবর নেয়া, শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তদারকি এবং তথ্য মন্ত্রণালয়কে জঙ্গিবাদবিরোধী ডকুমেন্টারি, নাটিকা, শর্ট ফিল্ম, বিজ্ঞাপনচিত্র ও ভিডিও ক্লিপ প্রস্তুত করে তা প্রচারের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। একইভাবে স্থানীয় সরকার এবং সমাজকল্যাণসহ অন্যান্য মন্ত্রণালয় ও দপ্তরকে পৃথক দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। তারাও কাজ করে যাচ্ছে।
গোয়েন্দা তথ্য মতে, জঙ্গিবাদ উত্থানের আশঙ্কা থাকা ১৪টি জেলা, ১২টি ইসলামী দল এবং ৫ হাজার মসজিদ-মাদ্রাসার কার্যক্রম মনিটর করা হচ্ছে। জামায়াত-শিবিরের সাম্প্রতিক কর্মকা-, তালিকাভুক্ত কওমি মাদ্রাসা, বিতর্কিত বেশ কয়েকটি উগ্র ইসলামী দল, ইসলামী দলের কয়েকজন শীর্ষ নেতা, নিষিদ্ধ ঘোষিত জেএমবি, হুজি, হিযবুত তাহ্রীর এবং আনসারুল্লাহ বাংলা টিমসহ এ ধরনের কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রমের ওপর নজর রাখছে গোয়েন্দা সংস্থাগুলো। হরতাল-অবরোধের দীর্ঘ এই সময়ে একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা এবং স্থানীয় প্রশাসনের প্রতিবেদন অনুযায়ী, জঙ্গিবাদের উত্থান হতে পারে এমন ঝুঁকিপূর্ণ ১৪টি জেলা চিহ্নিত করে সেগুলোতে নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে জামায়াত-শিবিরের চিহ্নিত নেতাকর্মীরা এসব জেলায় ভাংচুর, অগি্নসংযোগ, লুটপাট ও সংঘর্ষ ঘটায়। জেলাগুলো হচ্ছে ঢাকা, চট্টগ্রাম, বগুড়া, রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, যশোর, সাতক্ষীরা, গাজীপুর, দিনাজপুর, গাইবান্ধা, জয়পুরহাট, সিরাজগঞ্জ, ফরিদপুর ও পাবনা। এসব জেলায় ছদ্মবেশে কাজ করছে একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা। তাদের দেয়া তথ্য মতে নিয়মিত অপারেশন চালানো হচ্ছে।
সূত্র মতে, গোয়েন্দা তৎপরতা অব্যাহত থাকায় গত ২০ জানুয়ারি পাকিস্তানি তিন নাগরিককে গ্রেপ্তার করা হয়। তারা পাকিস্তানভিত্তিক জঙ্গি সংগঠন তেহরিক-ই-তালিবান অব পাকিস্তানের (টিটিপি) সক্রিয় সদস্য। রিমান্ডে তারা এ দেশের জঙ্গিদের সম্পর্কে চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়েছে। এ ঘটনার ৪ দিন পর শুক্রবার রাজধানীর খিলক্ষেত এলাকা থেকে নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন হিযবুত তাহ্রীরের ৮ সদস্যকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। একই দিন কলাবাগান এলাকা থেকে একজন নারী সদস্যকে আটক করা হয়। একই দিন শেওড়াপাড়া এলাকা থেকে একই দলের একজন কর্মীকে আটক করে র‌্যাব সদস্যরা। বিষয়টি শনিবার এক সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়।
সূত্র: দৈনিক যায় যায় দিন, ২৭ জানুয়ারি ২০১৪

, ,

0 comments

আপনার মন্তব্য লিখুন