মনোবল হারাচ্ছেন গার্মেন্ট মালিকেরা

বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম রফতানিকারক হিসেবে যে তৈরী পোশাক সম্ভাবনাময় দেশের তালিকায় বাংলাদেশের নাম লিখিয়েছে সেই তৈরী পোশাক শিল্পের কারণেই বিশ্ববাজারে এখন চরম ভাবমূর্তি সঙ্কটে ভুগছে বাংলাদেশ। প্রতিনিয়ত শ্রমিক অসন্তোষ ও কারখানা ভাঙচুর। পুলিশি নির্যাতনের শিকার হয়ে আমিনুল ইসলামসহ অসংখ্য শ্রমিকের মৃত্যু। হা-মীম, গরীব অ্যান্ড গরীব এবং তাজরীনের মতো ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড। রানা প্লাজার মতো বিশ্বকাঁদানো ভবনধস। আসওয়াদ দুর্ঘটনায় তৈরী পোশাকের বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি এখন তলানিতে ঠেকেছে। সর্বশেষ স্ট্যান্ডার্ড গ্রুপের ১০ তলা ভবন শ্রমিকদের আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যাওয়ায় মনোবল ভেঙে গেছে সব উদ্যোক্তারই।
সারা দেশে গ্যাস-বিদ্যুতের তীব্র সঙ্কট চলছে। বিশ্ববাজারে চলছে দীর্ঘকালীন মন্দা। মাত্রাতিরিক্ত বেড়েছে ডিজেল ও ফার্নেস অয়েলসহ সব ধরনের জ্বালানির দাম। মূল্যস্ফীতির প্রভাবে বেড়েছে বেতনভাতাসহ অন্যান্য খরচও। এসব কারণে উদ্যোক্তাদের পক্ষে কঠিন হয়ে পড়েছে আয়-ব্যয়ের হিসাব মেলানো। ফলস্বরূপ দেশে প্রতি মাসে বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল অন্তত ১০০টি তৈরী পোশাক কারখানা। বর্তমান সরকারের সময়ে বন্ধ হয়ে যাওয়া কারখানার সংখ্যা সাড়ে তিন হাজারেরও বেশি। তার ওপর সাভারে ভবনধসের ঘটনায় রফতানি বাণিজ্যে ৮০ শতাংশ অবদান রাখা দেশের প্রধান শিল্প খাতের ওপর নেমে এসেছে ভয়াবহতম খড়গ। দীর্ঘকালীন অস্থিরতার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে জাতীয় অর্থনীতিতে।
ওভেন ও সোয়েটার খাত নিয়ে কাজ করা তৈরী পোশাক প্রস্তুতকারক ও রফতানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএ ২০০৮ সালে সারা দেশের ওভেন কারখানার যে তালিকা তৈরি করে, তাতে মোট কারখানা ছিল পাঁচ হাজার ৬০৮টি। সর্বসম্প্রতি তৈরি করা তালিকায় চালু কারখানার সংখ্যা দাঁড়িয়েছে তিন হাজার ২৬০টি। তাদের হিসাবে ২০০৮ সাল থেকে এ পর্যন্ত গত চার বছরে গার্মেন্ট বন্ধ হয়ে গেছে দুই হাজার ৩৪২টি। অব্যাহত শ্রমিক ছাঁটাই, মাসের পর মাস মজুরি বকেয়া পড়া, রাতের অন্ধকারে কারখানার দরজা বন্ধ করে মালিকের পলায়নের মতো অনাকাক্সিত দৃশ্যের অবতারণা হচ্ছে প্রতিদিনই।
এ সময়ের মধ্যে নিটওয়্যার কারখানা বন্ধ হয়েছে আরো এক হাজারের মতো। সুতার জন্য হাহাকার করতে করতে বন্ধ হয়ে গেছে হ্যান্ডলুম ও পাওয়ারলুম সেক্টরের আরো ৬০ হাজার তাঁত। উদ্যোক্তাদের সংগঠন বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) দেয়া তথ্যানুযায়ী, তাদের সংগঠনভুক্ত এক হাজার ৭৬৫ কারখানার মধ্যে সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী মাত্র ৭৭০টি চালু অবস্থায় আছে। বাকিগুলো এরই মধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে। দামি মেশিনগুলো রক্ষার প্রয়োজনে পোশাকের আরেক উপখাত টেক্সটাইল-স্পিনিং কারখানাগুলো পুরো বন্ধ করা না হলেও চালু রাখা হয়েছে নামে মাত্র।
এ খাতের উদ্যোক্তাদের আরেক সংগঠন বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশন (বিটিএমএ)। দেশের সর্বাধিক ৩৫ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগে গড়ে ওঠা ৩৬০টি কমপোজিট টেক্সটাইল মিলের পাশাপাশি দেড় হাজারের মতো উইভিং ফ্যাক্টরির মালিকও এ সংগঠনের সদস্য। তাদের দাবি, লাখ লাখ টন সুতা অবিক্রীত থাকায় টেক্সটাইল মিলগুলো তাদের উৎপাদনক্ষমতার অর্ধেক ব্যবহার করে লোকসান দিয়ে কোনোমতে চালু রয়েছে। বিকল হয়ে পড়ার ভয়ে কোটি কোটি টাকার মেশিন চালু রাখতে গিয়ে তারা তেল পোড়াচ্ছেন লাখ লাখ টাকার। আর উইভিং মেশিনগুলো বন্ধ হয়ে গেছে অর্ধেকেরও বেশি।
উদ্যোক্তারা জানান, গ্যাস-বিদ্যুৎ সঙ্কটের পাশাপাশি সুতার দাম অত্যধিক বেড়ে যাওয়ায় দেশের সম্ভাবনাময় তাঁত শিল্প ধ্বংসের মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছে। আয়-ব্যায়ের সাথে সামঞ্জস্য বিধানে ব্যর্থ হয়ে ইতোমধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে দেড় লক্ষাধিক পাওয়ার লুম। নরসিংদী এবং সিরাজগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে থাকা তাঁত শিল্পের সাথে সংশ্লিষ্ট ২৫ লক্ষাধিক লোক এখন মানবেতর জীবন যাপন করছেন। পূর্বপুরুষের পেশা ছেড়ে অনেক তাঁতি বাধ্য হচ্ছে বিকল্প কাজের সন্ধান করছেন।
একের পর এক কারখানা বন্ধ হওয়ার কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি এবং বর্তমানে এক্সপোর্টারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ইএবি) সভাপতি আবদুস সালাম মুর্শেদী কয়েকটি কারণের কথা উল্লেখ করেন। প্রথমত, সরকারের ঘোষণা অনুযায়ী গ্যাস-বিদ্যুতের কোনো উন্নতি তো হয়ইনি, উল্টো সমস্যা আরো গুরুতর হয়েছে। ফলে অতিরিক্ত ডিজেল ও ফার্নেস অয়েল কিনতে গিয়ে উদ্যোক্তারা দিশেহারা হয়ে পড়ছেন। দ্বিতীয়ত, ব্যাংকঋণের ওপর সুদহার কমানোর ঘোষণা দেয়া হলেও বাস্তবে তা আরো বেড়েছে। বর্ধিত সুদহারে ঋণ নিয়ে ব্যবসায় করতে গিয়ে গার্মেন্ট শিল্পমালিকেরা আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতা করার সক্ষমতা হারিয়ে ফেলছেন। এসব সমস্যার সাথে নতুন করে রানা প্লাজার ঘটনা যুক্ত হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, পরিস্থিতি ভালোভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে আয়-ব্যয়ের হিসাব মেলাতে ব্যর্থ হয়ে হাজার হাজার ছোট কারখানা বন্ধ হয়ে যাবে।
সূত্র: দৈনিক নয়া দিগন্ত, ০৯ ডিসেম্বর ২০১৩

,

0 comments

আপনার মন্তব্য লিখুন