তারানকোর দিকে তাকিয়ে দেশ

জাতিসংঘ মহাসচিবের বিশেষ দূত ও সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকোর দিকে তাকিয়ে আছে গোটা দেশ। তিনি এ দেশে রাজনৈতিক সংকট নিরসনে দিশা দেবেন_ এই প্রত্যাশা সবার। তাই শুধু রাজনৈতিক মহল নয়, সুশীল সমাজসহ সব শ্রেণির মানুষের মধ্যে তারানকোর এই সফর নিয়ে আছে ব্যাপক আগ্রহ। তারা এটাকে দেখছেন রাজনৈতিক সমঝোতার শেষ উদ্যোগ হিসেবে।
এ নিয়ে গত শুক্রবার তৃতীয় দফায় ঢাকায় এলেন অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকো। এর আগে গত মে মাসে এবং সর্বপ্রথম গত বছর ডিসেম্বরে ঢাকায় এসেছিলেন তিনি। প্রতিবারই তার লক্ষ্য ছিল এ দেশে চলমান রাজনৈতিক সংকট নিরসন।
জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং বিরোধীদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়ার সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলেছেন। চিঠিও দিয়েছেন একাধিকবার। আর তারানকোর তৃতীয় দফা ঢাকা সফরের আগেও গত সপ্তাহে দুই নেত্রীকে চিঠি দিয়েছেন জাতিসংঘের মহাসচিব। প্রতিবারই চিঠি বা টেলিফোনে তিনি আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে রাজনৈতিক সংকট নিরসনের কথা বলেছেন। বলেছেন সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচনের কথা।
এবার তারানকো এমন এক সময়ে ঢাকায় এলেন, যখন এ দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি চরম সংঘাতময় এবং সহিংস হয়ে উঠেছে। বিএনপি নেতৃত্বাধীন বিরোধী ১৮ দলীয় জোট টানা হরতাল-অবরোধ দিয়ে যাচ্ছে। তারানকোর সফরের সময়ও অবরোধে বিরতি নেই। সরকারও একতরফা নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। দেশ স্থবির হয়ে পড়ছে। সহিংসতায় প্রাণ হারাচ্ছে সাধারণ মানুষ।
এসব কারণে তারানকোর এবারকার বাংলাদেশ সফরের আলাদা গুরুত্ব রয়েছে বলে মনে করেন রাজনীতি এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিশ্লেষক অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ। তিনি বলেন, তারানকোর উদ্যোগ সফল না হলে পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ হয়ে উঠবে।
জাতিসংঘ মহাসচিবের বিশেষ দূত ফার্নান্দেজ তারানকো শনিবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং বিরোধীদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়ার সঙ্গে বৈঠক করেছেন। রোববার তিনি বৈঠক করেন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এইচএম এরশাদ, প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ এবং নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি ড. কামাল হোসেনের সঙ্গে। এছাড়া অনির্ধারিত বৈঠক করেন প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা ড. গওহর রিজভী, বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা শমসের মবিন চৌধুরী এবং বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতের হাইকমিশনার পঙ্কজ শরণের সঙ্গে। এছাড়া আরো কয়েকটি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে তার বৈঠকের কথা রয়েছে। জানা গেছে, তিনি রাষ্ট্রপতি এবং সেনাপ্রধানের সঙ্গেও বৈঠক করতে চাইছেন। তবে সেই সুযোগ তিনি পাবেন না বলেই মনে হচ্ছে।
এরশাদের সঙ্গে বৈঠক
জাতিসংঘের দূত অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকোর সঙ্গে বৈঠকে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ বলেছেন, তারা 'সব দলের জন্য সম্মানজনক' একটি সমাধান চান। এজন্য তফসিল পরিবর্তন করে 'সব দলকে' নির্বাচনে আসার সুযোগ দেয়ার দাবি জানান তিনি।
রাজধানীর বারিধারায় এরশাদের প্রেসিডেন্ট পার্কের বাসায় সকাল সাড়ে ৯টা থেকে প্রায় এক ঘণ্টা বৈঠক শেষে বেরিয়ে যাওয়ার সময় জাতিসংঘের দূত সাংবাদিকদের সঙ্গে কোনো কথা বলেননি। তবে বৈঠক সম্পর্কে সাংবাদিকদের জানিয়েছেন জিএম কাদের ও রুহুল আমীন হাওলাদার।
রুহুল আমীন হাওলাদার বলেন, 'আমাদের আলোচনা ফলপ্রসূ হয়েছে। দেশের সার্বিক অবস্থা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। আমরা আমাদের বক্তব্য তুলে ধরেছি।'
জাতীয় পার্টি কোন দাবির কথা বলেছে_ জানতে চাওয়া হলে মহাসচিব বলেন, 'আমরা চাই একটি সম্মানজনক সিদ্ধান্ত, যাতে বিরোধী দল-সরকারি দল সবাই আসতে পারে, ভোটে অংশ নিতে পারে।' জাতিসংঘের দূত কী বলেছেন_ জানতে চাওয়া হলে হাওলাদার বলেন, 'তিনি দেশের সার্বিক পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চেয়েছেন।'
এরপর জিএম কাদের সাংবাদিকদের বলেন, 'আমাদের মূল বক্তব্য ছিল তফসিল পরিবর্তন। তফসিল পেছাতে হবে। আমরা চাই সব দল যেন নির্বাচনে আসে, যাতে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হয়।'
সিইসির সঙ্গে বৈঠক
জাতীয় পার্টিপ্রধানের সঙ্গে বৈঠকের পর প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী রকিবউদ্দীন আহমদের সঙ্গে বৈঠক করেন জাতিসংঘের বিশেষ দূত অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকো। বৈঠকে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন পেছানোর সুযোগ আছে কিনা জানতে চান তারানকো। জবাবে সিইসি নির্বাচন পেছানো সম্ভব বলে তাকে জানান। তবে এ ক্ষেত্রে নির্বাচনে সবার অংশগ্রহণ এবং যারা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হতে যাচ্ছেন, তাদের মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করার শর্ত দেন সিইসি।
সূত্র জানায়, আগামী ২৪ জানুয়ারির মধ্যে নির্বাচন করার ব্যাপারে অনড় ইসি। নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক সমঝোতা হলে এই সময়ের মধ্যেই নির্বাচন করতে আগ্রহী কমিশন।
বৈঠক সূত্র জানায়, বড় দুই দল একমত হলে এবং প্রকাশ্যে নির্বাচনে অংশগ্রহণের ঘোষণা দিলে যে কোনো দিন নির্বাচন অনুষ্ঠান করা সম্ভব বলে তারানকোকে জানিয়েছেন সিইসি।
সিইসি বলেন, কমিশনের সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা রয়েছে। নির্বাচন করা ছাড়া অন্য কোনো সুযোগ নেই কমিশনের। তবে সব দলের মধ্যে রাজনৈতিক সমঝোতা হলে সংবিধানের মধ্যে থেকে ২৪ জানুয়ারির আগে যে কোনো দিন নির্বাচন করার সুযোগ আছে। এ ক্ষেত্রে দলগুলোকে নির্বাচনে আসার ঘোষণা দিতে হবে।
সূত্র জানায়, সিইসির এই বক্তব্য সম্পর্কে তারানকো কোনো মন্তব্য করেননি। এ ব্যাপারে সবার সঙ্গে আলোচনা করার কথা জানিয়েছেন তিনি।
নাগরিক প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক
জাতিসংঘের দূত অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকোর সঙ্গে বৈঠক করে নির্বাচন পেছানোর ওপর জোর দিয়েছেন নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা, যাতে সব দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা যায়। রোববার দুপুর আড়াইটার দিকে নাগরিক সমাজের চারজন প্রতিনিধির সঙ্গে বৈঠকে বসেন তারানকো।
আইনজীবী ড. কামাল হোসেন ও শাহদীন মালিক, অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী এবং সুজনের সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার রাজধানীর একটি হোটেলে এই বৈঠকে অংশ নেন।
প্রায় ঘণ্টাখানেক পর বৈঠক শেষে বেরিয়ে এসে ড. কামাল হোসেন সাংবাদিকদের জানান, ফার্নান্দেজ তারানকো তাদের কাছে বাংলাদেশের পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চেয়েছেন। তারা বলেছেন, আইনতভাবে নির্বাচন এখনো পেছানো সম্ভব বলে তারা মনে করেন। তারা আরো বলেছেন, সবার কাছে গ্রহণযোগ্য একটা সমাধান দরকার। একতরফা নির্বাচনের এই রেলগাড়িটা থামাতে হবে।
শাহদীন মালিক জানান, ২০০৮ সালের নির্বাচনে ৮৭ শতাংশ ভোট পড়েছিল। দেশের মানুষ চায় ওই রকম একটি নির্বাচন, যাতে সবার অংশগ্রহণ থাকবে।
জাতিসংঘের দূতের সঙ্গে কী কথা হয়েছে_ জানতে চাওয়া হলে তিনি জানান, তারা নিউইয়র্ক থেকে কোনো ফর্মুলা নিয়ে আসেননি। তিনি সবার সঙ্গে কথা বলবেন। সবাই যেটা চায়, তেমন একটি নির্বাচনই তারা চান।
তারানকো-মবিন বৈঠক
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শমসের মবিন চৌধুরীর সঙ্গে বৈঠক করেছেন জাতিসংঘের বিশেষ দূত ও সহকারী মহাসচিব অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকো।
রোববার সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় বৈঠক শুরু হয়ে শেষ হয় রাত পৌনে ৯টায়। রাজধানীর বনানী ডিওএইচএসে শমসের মবিন চৌধুরীর বাসায় এ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।
বৈঠক শেষে শমসের মবিন চৌধুরী সাংবাদিকদের বলেন, 'তারানকোর সঙ্গে আমাদের আলোচনা চলছে, শেষ হয়নি। আগামীকালও (সোমবার) আলোচনা হবে।'
সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, 'আলোচনা চলছে, চলবে। এখনই কিছু বলা যাবে না। কারণ, বিষয়টি স্পর্শকাতর।'
সোমবার (আজ) তারানকোর সঙ্গে বৈঠকের পর সাংবাদিকদের আলোচনার সিদ্ধান্ত জানানো হবে বলে জানিয়েছেন শমসের মবিন চৌধুরী। বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের কিছু না বলে শমসের মবিন চৌধুরীর বাসা ত্যাগ করেন তারানকো। বৈঠকে বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা সাবিহ উদ্দীন আহমেদ এবং তারানকোর ৪ সফরসঙ্গী উপস্থিত ছিলেন।
আজ খালেদার সঙ্গে বৈঠক
আজ সন্ধ্যায় গুলশানের বাসভবনে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সঙ্গে দ্বিতীয় দফায় বৈঠকে বসবেন জাতিসংঘের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকো। এর আগে শনিবার সন্ধ্যায় তার সঙ্গে বিরোধীদলীয় নেত্রীর দুই ঘণ্টা বৈঠক হয়। বৈঠকের পর বিএনপির পক্ষ থেকে তেমন কিছুই জানানো হয়নি। তবে বৈঠকের পর বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শমসের মবিন চৌধুরী জানান, বৈঠকের ব্যাপারে এখনই কিছু বলা যাবে না। আরো বৈঠক হবে, তখন জানানো হবে।
জামায়াতের বৈঠক বাতিল
এদিকে, জামায়াতের সঙ্গে জাতিসংঘের সহকারী মহাসচিব ফার্নান্দেজ তারানকোর পূর্ব নির্ধারিত বৈঠক স্থগিত করা হয়েছে।
রোববার বিকাল সাড়ে ৩টায় রাজধানীর সোনারগাঁও হোটেলে এ বৈঠক অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল। জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক বৈঠক স্থগিত করার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
তিনি জানান, তারানকোর আরো কয়েকটি বৈঠক থাকায় রোববার বৈঠকটি হয়নি। তবে সোমবার এই বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। রোববারের বৈঠকে ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক ছাড়াও ৪ জন জামায়াত নেতার উপস্থিত থাকার কথা ছিল।
সূত্র: দৈনিক যায় যায় দিন, ০৯ ডিসেম্বর ২০১৩

, ,

0 comments

আপনার মন্তব্য লিখুন