মন্দ ঋণে ব্যাংকের মুনাফা কমছে

ব্যাংকিং খাতে মন্দ ঋণ বেড়ে যাওয়ায় প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হচ্ছে বেশি হারে। আর এ প্রভিশন সংরক্ষণ করা হয় ব্যাংকের আয় খাত থেকে টাকা এনে। যে ব্যাংকের খেলাপি ঋণ যত বেশি ওই ব্যাংকের আয় খাত থেকে বেশি পরিমাণ প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হয়। আর বেশি পরিমাণ প্রভিশন সংরক্ষণ করতে গিয়ে অনেক কমে যাচ্ছে নিট মুনাফার পরিমাণ। মন্দ ঋণের বিপরীতে শুধু প্রভিশনই সংরক্ষণ করতে হচ্ছে না, এ ঋণের বিপরীতে অর্জিত সুদও ব্যাংকের আয় খাতে স্থানান্তর করতে পারছে না। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান মতে, সাড়ে ৭ হাজার কোটি টাকার আয় থেকে বঞ্চিত হচ্ছে ব্যাংকগুলো। গত ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৫৬ হাজার ৭০২ কোটি টাকার খেলাপি ঋণের মধ্যে ৩৯ হাজার ৪৪৫ কোটি টাকাই মন্দ ঋণ। বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালা অনুযায়ী, এ মন্দ ঋণের বিপরীতে সুদ আয় স্থগিত করে রাখা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালা অনুযায়ী মন্দ ঋণের বিপরীতে ধার্যকৃত সুদ ব্যাংকগুলোর আয় খাত থেকে আলাদা করে রাখা হয়। অন্যদিকে, এ ঋণের বিপরীতে ব্যাংকগুলোর আয় খাত থেকে টাকা এনে প্রভিশন রাখতে হয়। এর ফলে একদিকে ব্যাংকগুলোর মুনাফার পরিমাণ কমে যাচ্ছে পাশাপাশি শেয়ারহোল্ডাররাও বছর শেষে প্রকৃত লভ্যাংশ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, ব্যাংকগুলোর মন্দ ঋণের মধ্যে চার রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকেরই অর্ধেক। গত ৩০ সেপ্টেম্বর শেষে দেশের ৩৯ হাজার ৪৪৫ কোটি টাকার মন্দ ঋণের মধ্যে চার রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকেরই ১৯ হাজার ২২৭ কোটি টাকা। অথচ ৬ মাস আগেও অর্থাৎ গত ৩০ মার্চ পর্যন্ত ৫১ হাজার খেলাপি ঋণের মধ্যে মন্দ ঋণ ছিল ৩৬ হাজার ৩৪ কোটি টাকা। মন্দ ঋণ বেড়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, সরকারি ব্যাংকগুলোতে হলমার্ক, বিস্মিল্লাহসহ বড় বড় ঋণ কেলেংকারি হয়েছে। শুধু সোনালী ব্যাংকের হলমার্ক কেলেংকারির সঙ্গেই দেশের ২৬টি বাণিজ্যিক ব্যাংক জড়িয়ে পড়েছে। এসব ঋণ দীর্ঘদিন ধরে অনাদায়ী রয়েছে। মূলত ঋণ কেলেংকারি বেড়ে যাওয়াই মন্দ ঋণ বেড়ে গেছে। মন্দ ঋণ আদায়ের জন্য ব্যাংক আদালতে মামলা করে থাকে। কিন্তু আইনগত জটিলতায় তা বছরের পর বছর অনাদায়ী থাকে। কেননা, এসব ঋণ রাজনৈতিক বিবেচনায় বিতরণ করা হয়। আর এক্ষেত্রে ঋণের বিপরীতে পর্যাপ্ত জামানত নেয়া হয় না।
বেড়েছে মন্দ ঋণ : দেশের প্রচলিত বিধান অনুযায়ী কোনো নিয়মিত ঋণের কিস্তি পরিশোধের সীমা উত্তীর্ণ হওয়ার ৩ মাস অতিক্রান্ত হলে তা শ্রেণীকৃত ঋণ বা খেলাপি ঋণ হিসাবে ধরা হয়। এ খেলাপি ঋণকে ব্যাংকিং ভাষায় সাব-স্ট্যান্ডার্ড বা নিুমান ঋণ বলা হয়। এ ঋণের বিপরীতে ব্যাংকগুলোকে ২০ শতাংশ প্রভিশন রাখতে হয়। ঋণের কিস্তি পরিশোধের সীমা উত্তীর্ণ হওয়ার ৬ মাস অতিক্রান্ত হলে তা সন্দেহজনক ঋণ হিসাবে ধরা হয়। এ ঋণের বিপরীতে ব্যাংকগুলোকে ৫০ শতাংশ প্রভিশন রাখতে হয়। আবার ঋণের কিস্তি পরিশোধের সীমা ৯ মাস অতিক্রান্ত হলে তা মন্দ ঋণ হিসাবে ধরা হয়। এ মন্দ ঋণের বিপরীতে শতভাগ প্রভিশন রাখতে হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের নতুন নীতিমালা অনুযায়ী, খেলাপি ঋণের বিপরীতে সম্পদ থাকলেও ১৫ শতাংশ প্রভিশন রাখতে হয়। আগে সম্পদ থাকলে কোনো প্রভিশন রাখতে হতো না। জানা গেছে, মন্দ ঋণ ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদ হিসাবে ধরা হয়। আর এ ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের বিপরীতে ব্যাংকগুলোকে ১০০ শতাংশ প্রভিশন রাখতে হয়। প্রভিশন ঘাটতি হলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে ব্যাংকগুলোর জরিমানা বা তিরস্কার গুনতে হয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তিরস্কার বা জরিমানার হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য ব্যাংকের আয় খাত থেকে টাকা এনে প্রভিশন ঘাটতি পূরণ করে থাকে। পাশাপাশি, মন্দ ঋণের বিপরীতে অর্জিত সুদ ব্যাংকগুলোর আয় খাতে স্থানান্তর করা হয় না। অর্জিত সুদ ব্যাংকের আলাদা হিসাবে স্থগিত করে রাখা হয়। গত ৩০ সেপ্টেম্বর প্রান্তিক পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দেশের ব্যাংকিং খাতের ৩৯ হাজার ৪৪৫ কোটি টাকার মন্দ ঋণের বিপরীতে ৭৫৬১ কোটি টাকার সুদ আয় খাতে আনা যায়নি। এটা ব্যাংকের আলাদা হিসেবে রাখা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান মতে, ৩০ সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে বেশি সুদ স্থগিত করা হয়েছে সরকারি মালিকানাধীন চার ব্যাংকের। ব্যাংক চারটিতে এ সময়ে ২৪ হাজার ১৭৪ কোটি টাকার খেলাপি ঋণের মধ্যে ১৯ হাজার ২২৭ কোটি টাকাই মন্দ ঋণ রয়েছে। এর বিপরীতে প্রভিশন সংরক্ষণ করার পরেও ৩ হাজার ৫৮০ কোটি টাকার সুদ আয় স্থগিত করে রাখা হয়েছে। অথচ ৬ মাস আগেও অর্থাৎ গত ৩০ মার্চ প্রান্তিকে ছিল ৩ হাজার ৩৭৯ কোটি টাকা।
বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংক আলোচ্য সময়ে সুদ স্থগিত করেছে ২ হাজার ৮৫৫ কোটি টাকা, যা ৬ মাস আগে ছিল ২ হাজার ২৮৯ কোটি টাকা। বেসরকারি ব্যাংকগুলোর ২২ হাজার ৩০৭ কোটি টাকার খেলাপি ঋণের মধ্যে ১৩ হাজার ১৮০ কোটি টাকাই মন্দ ঋণ। এ সময়ে বিদেশী ব্যাংকগুলো সুদ স্থগিত করেছে ১৪৫ কোটি টাকা। আর বিশেষায়িত ব্যাংকগুলোর সুদ আয় স্থগিত করে রাখা হয়েছে ৯৮০ কোটি টাকা। মন্দ ঋণ বেড়ে যাওয়ায় প্রভিশন সংরক্ষণ করতে গিয়ে ব্যাংকগুলোর নিট আয় কমে গেছে। শুধু ব্যাংকগুলোর নিট লোকসানই বাড়েনি, ব্যাংকগুলোর ইতোমধ্যে মূলধন ঘাটতি বেড়ে গেছে। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর মূলধন ঘাটতি মেটানোর জন্য সরকার ৫ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যা প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।
বেড়েছে প্রভিশন ঘাটতি : ব্যাংকিং খাতে প্রভিশন ঘাটতির পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে। গত তিন মাসে বেড়েছে ৩৩ দশমিক ২৭ শতাংশ। আর এ কারণে ব্যাংকিং খাতে আর্থিক ঝুঁকির পরিমাণ বাড়ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান মতে, গত ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকিং খাতে ৫৬ হাজার ৭২০ কোটি টাকার খেলাপি ঋণের বিপরীতে প্রভিশন সংরক্ষণ করার কথা ছিল ৩২ হাজার ২৭ কোটি টাকা, কিন্তু এ সময়ে সংরক্ষণ করা হয়েছে ২৮ হাজার ৭৪৬ কোটি টাকা। ঘাটতি রয়েছে ৩ হাজার ২৮১ কোটি টাকা। এ ঘাটতি তিন মাস আগে অর্থাৎ গত জুন শেষে ছিল ২ হাজার ৪৬২ কোটি টাকা। তিন মাসে প্রভিশন ঘাটতি বেড়েছে ৮১৯ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র মতে, আমানতকারীদের আমানত ব্যাংকের আর্থিক ঝুঁকি থেকে রক্ষার জন্য পর্যাপ্ত মূলধন রাখার বিধান রয়েছে। একই কারণে খেলাপি ঋণের বিপরীতে পর্যাপ্ত মূলধন রাখারও বিধান রয়েছে। কিন্তু ঋণের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ খেলাপি হওয়ায় এবং সে অনুযায়ী প্রভিশন সংরক্ষণ না করায় ব্যাংকগুলোর আর্থিক ঝুঁকির পরিমাণ বেড়ে গেছে। বিশেষ করে রাষ্ট্রায়ত্ত ও সরকার পরিচালিত বিশেষায়িত ব্যাংকগুলোতে এ ঝুঁকির প্রবণতা বেড়েছে বেশি। জানা গেছে, ঋণ শ্রেণীকরণের তিনটি পর্যায় রয়েছে। তা হল- নিুমান, সন্দেহজন এবং মন্দ বা ক্ষতি। এই তিনটি পর্যায় বিবেচনায় নিয়ে ব্যাংকগুলোকে নিরাপত্তা সঞ্চিতি (প্রভিশন) সংরক্ষণ করতে হয়। প্রভিশন সংরক্ষণের বিধিমালা অনুযায়ী, কোনো ঋণ নিুমান হলে তার বিপরীতে ব্যাংকগুলোকে ২০ শতাংশ প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হয়। আর পর পর ৬ মাস ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হলে সে ঋণকে সন্দেহজনক ঋণ বলা হয়। আর এ ঋণের বিপরীতে ব্যাংকগুলোকে ৫০ শতাংশ প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হয়। আর ৯ মাস অতিবাহিত হলে ওইসব ঋণকে মন্দ ঋণ বলা হয়। আর এ মন্দ ঋণের বিপরীতে ব্যাংকগুলোর শতভাগ প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হয়। দেশের প্রথম প্রজম্মের একটি ব্যাংকের এমডি জানিয়েছেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নতুন নীতিমালা বাস্তবায়ন করতে গিয়ে বেশিরভাগ ব্যাংকের মুনাফা কমে যাচ্ছে। তার মধ্যে বিশেষ করে প্রথম ও দ্বিতীয় প্রজম্মের ব্যাংকগুলো পড়েছে বিপাকে। কেননা এসব ব্যাংকগুলোর পুঞ্জীভূত খেলাপি ঋণ বেশি। খেলাপি ঋণের বিপরীতে প্রভিশন রাখা হয় ব্যাংকের আয় থেকে। প্রভিশন সংরক্ষণ না করে শেয়ারহোল্ডারদের লভ্যাংশ দেয়া যায় না। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, রাষ্ট্রীয় মালিকানার সোনালী ব্যাংকে ৭৯৯ কোটি ৮ লাখ, রূপালী ব্যাংকে ১৭৩ কোটি ৬৯ লাখ, বেসরকারি মালিকানার বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের ১০১ কোটি ৬৯ লাখ, যমুনা ব্যাংকের ৩ লাখ, ন্যাশনাল ব্যাংকের ৪০১ কোটি ৩ লাখ, প্রিমিয়ার ব্যাংকের ৩ কোটি ৯৫ লাখ, বিদেশী মালিকানার ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তানের ৩২০ কোটি ৫৮ লাখ, রাষ্ট্রীয় মালিকানার বিশেষায়িত খাতের বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের এক হাজার ৫৭১ কোটি ৪০ লাখ, বেসিক ব্যাংকের ৩০৩ কোটি ৭৪ লাখ এবং রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের ৩০৫ কোটি ৩১ লাখ টাকা প্রভিশন ঘাটতি রয়েছে। এ ১০ ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ৯৮০ কোটি ৯৮০ কোটি ৫০ লাখ টাকা। তবে কিছু ব্যাংকের প্রভিশন বেশি থাকায় তা সমন্বয় করে ব্যাংকিং খাতে প্রকৃত প্রভিশন ঘাটতির পরিমাণ হচ্ছে ৩ হাজার ২৮১ কোটি ৭৪ লাখ টাকা। পরিসংখ্যানে দেখা যায়, রাষ্ট্রীয় মালিকানার বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে প্রভিশন ঘাটতি রয়েছে ৪৭৪ কোটি ৯২ লাখ টাকা, বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলোতে ৩৩১ কোটি ১৩ লাখ টাকা, বিদেশী ব্যাংকগুলোতে ২৯৫ কোটি ২৬ লাখ টাকা এবং বিশেষায়িত খাতের ব্যাংকগুলোতে ২ হাজার ১৮০ কোটি ৪৩ লাখ টাকা।
সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ১৭ নভেম্বর ২০১৩

,

0 comments

আপনার মন্তব্য লিখুন