সংকটে বিশ্বের বড় কোম্পানিগুলো

বিশ্বের অনেক অর্থনীতিবিদ বলে আসছিলেন, বিশ্বের অর্থনীতিতে গতি আসছে। তার মানে গতি আসছে এশিয়ার অর্থনীতিতেও। বলা হচ্ছিল, কেটে যাচ্ছে ইউরোজোনের অর্থনৈতিক মন্দা। এখন বলা হচ্ছে ফের সংকটে পড়তে যাচ্ছে ইউরোজোনের অর্থনীতি। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, এর অন্যতম কারণ বিশ্বের মুদ্রাবাজারে অস্থিরতা। তারা আরও বলেছেন, মুদ্রার এ অস্থিরতা সহসা না-ও কাটতে পারে। মুদ্রাবাজারে অস্থিরতার কারণে বিশ্বের বিভিন্ন কোম্পানির আয় কমেছে। মুদ্রার দরপতন হয়েছে উদীয়মান বাজারেও। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে পশ্চিমা কোম্পানিগুলোও।

সাম্প্রতিক বছরগুলোয় বেশ ভালোই আয় হচ্ছিল বিকাশমান বাজারগুলো থেকে। কিন্তু চলতি বছরের (২০১৩) মাঝামাঝিতে প্রায় হঠাৎ করেই বাজারগুলোয় স্থানীয় মুদ্রার দরপতন ঘটে। এতে করে খুবই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কোম্পানিগুলোর বিক্রি ও মুনাফা। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, মুদ্রার দরপতন শুরু হয় মূলত যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংক তাদের বন্ড (মাসিক) ক্রয়ের প্রণোদনা দেয়ার আশংকার কারণেই, যার পরিপ্রেক্ষিতে বিক্রি ও মুনাফার দিক দিয়ে মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয় কোম্পানিগুলো।
সিএমসি মার্কেটের ব্যবসায়ী টবি মরিস বলেছেন, যেসব প্রতিষ্ঠান যথেষ্ট সক্রিয় ছিল বিকাশমান বাজারগুলোয় তারাই হয়েছে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। তিনি আরও বলেছেন, তৃতীয় প্রান্তিকে বিভিন্ন মাপ বা শ্রেণীর প্রতিষ্ঠান ব্যর্থ হয়েছে তাদের রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা পূরণে। এক্ষেত্রে অনেকেই দায়ী করেছেন ইউরোর উচ্চ বা চড়ামূল্যকে। এদিকে দক্ষিণ আমেরিকা ও ভারত সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে মুদ্রার দুর্বল অবস্থানের কারণে।

মুদ্রার ওঠানামার কারণে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কোকাকোলা থেকে শুরু করে ইউনিলিভার, আইবিএম, ক্যাসিনো ও এলভিএমএই (বিলাসবহুল পণ্যের কোম্পানি)। বিশেষজ্ঞরা এর প্রমাণ পেয়েছেন কোম্পানিগুলোর প্রান্তীয় ফলাফল পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে। বিভিন্ন কোম্পানি তৃতীয় প্রান্তিকের যে ফলাফল প্রকাশ করেছে তাতে উঠে এসেছে বিকাশমান বাজারগুলোর ঝুঁকির চিত্র। চলতি বছরের আগস্ট মাসে প্রায় এক পঞ্চমাংশ হ্রাস পেয়েছে দক্ষিণ আফ্রিকার র‌্যান্ড, ব্রাজিলের রিয়াল, তুরস্কের লিরা, ইন্দোনেশিয়ার রুপিয়া ও ভারতের রুপির দর। বলা যেতে পারে, এমন নাজুক অবস্থা দেখা দেয় উদীয়মান দেশগুলোতেও। এর প্রধান কারণ ছিল ডলারের দাম বৃদ্ধি পাওয়া।
বিকাশমান বাজারগুলো থেকে বিনিয়োগ প্রত্যাহার করে নেন বিনিয়োগকারীরা। তাদের আশংকা হল, যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ বা ফেডের নেয়া প্রণোদনা প্রকল্প বন্ধ করে দিতে পারে অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে। ফলে ডলারের বিপরীতে উল্লেখযোগ্য হারে কমতে থাকে এসব দেশের মুদ্রার দাম। অনেক বিনিয়োগকারীর ধারণা ছিল, প্রণোদনা প্রকল্প একেবারে বন্ধ না করা হলে তা কমানো হবে। তাতেও এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে বিভিন্ন দেশের মুদ্রার দামের ওপর।
ব্রোকার আওরেল বিজিজির অর্থনীতিবিদরা বলেছেন, এখন মোটেই ভালো নয়, বিকাশমান বাজারগুলোর অবস্থা। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় দেশগুলো যখন অর্থনৈতিক মন্দায়, তখনও প্রায় রমরমা ছিল উদীয়মান বিশ্বের বাজার। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার শুরু হওয়ার আগেই কমবেশি অস্থিরতা দেখা দেয় উদীয়মান দেশগুলোর মুদ্রা বাজারে।
বিকাশমান বাজারগুলোর মুদ্রার বিপরীতে উল্লেখযোগ্য হারে বেড়ে যায় ইউরোর দাম। উদ্বেগের বিষয় হল- মূলত ২০১২ সালের প্রায় প্রথম থেকে ডলারের বিপরীতে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে এর দর। স্লেইডার ইলেকট্রিক (ফ্রান্সের বৈদ্যুতিক সামগ্রী নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান) সতর্ক করে বলেছে, ইউরোর দাম বেড়ে যাচ্ছে মাত্রাতিরিক্ত হারে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ব্যবসা বাণিজ্য।
স্লেইডার ইলেকট্রিকের অর্থ-বিভাগের পরিচালক ইমানুয়েল বাবিউ গণমাধ্যমকে জানান, একমাত্র প্রধান অর্থনৈতিক অঞ্চল বলতেই বুঝায় ইউরো অঞ্চলকে, যারা মুদ্রাকে ব্যবহার করে না অর্থনৈতিক এবং প্রতিযোগিতার অস্ত্র হিসেবে। প্যারিসভিত্তিক কোম্পানিটির কর্মকর্তারা বলেছেন, এমন সময় ছিল, যখন অনেক বাজারে বেচাকেনা হয়েছে কয়েক বিলিয়ন ইউরোরও অধিক। কিন্তু এখন সেখানে ঘটেছে মুদ্রার অবমূল্যায়ন। ফলে পূরণ করা যাচ্ছে না প্রত্যাশা।
ভালো নেই রেনল্টের (গাড়ি নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান) অবস্থাও। তৃতীয় প্রান্তিকে ৩ শতাংশের কিছু বেশি বিক্রি কমেছে এদের। তবে একই হারে এ প্রান্তিকে বৃদ্ধি পেয়েছে এদের গাড়ির নিবন্ধনের হার। কোম্পানিগুলোর বিক্রি ৫ দশমিক ৭ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে উদীয়মান বাজারের মুদ্রাগুলোর দরপতনে, বলেছেন রেনল্টের বিক্রয় ও বিপণন বিভাগের পরিচালক জেরোমি স্টল। এর আংকিক মূল্য প্রায় ৪৪০ মিলিয়ন ইউরো।
ব্রাজিলে বড় ধরনের কার্যক্রম রয়েছে ফ্রান্সের সুপার মার্কেট গ্র“প ক্যাসিনো। উল্লেখিত সময়ে কোকাকোলার বিক্রি বেড়েছে প্রায় ৩ শতাংশ। অথচ একই হারে হ্রাস পায় নেট রাজস্ব। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, মুদ্রার প্রভাব যদি বাদ দেয়া হয় তাহলে এ প্রান্তিকে রাজস্ব বাড়ত প্রায় ৪ শতাংশ। ক্যাসিনো জানায়, সেখানে মুদ্রার দর পড়ে যাওয়ায় ৫ শতাংশের কিছু বেশি হ্রাস পেয়েছে কোম্পানির অর্গানিক বিক্রি।
যে অস্থিরতা চলছে বিকাশমান বাজারগুলোয়, তার কারণেই নানা চ্যালেঞ্জ দেখা দিয়েছে ব্যাস্টিক অর্থনীতিতে। এমন মন্তব্য করেছেন কোকাকোলার প্রধান নির্বাহী মাহতার কেন্ট। বিশ্লেষকরা আশংকার সঙ্গে বলেছেন, মুদ্রার খারাপ বা নেতিবাচক প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে আগামী প্রান্তিকগুলোয়।

এরই মধ্যে আমরা লক্ষ্য করছি মুদ্রার অস্থির অবস্থার প্রভাব, বলেছেন আমুন্দি অ্যাসেট ম্যানেজমেন্টের ইকুইটি বিভাগের গ্লোবাল হেড রোমেইন বোসকার। কিন্তু এর প্রভাব আরও জটিল বা ঘনীভূত হবে আগামী প্রান্তিকগুলোয়। অবশ্য তা হবে যদি ইতিবাচক দিক দেখা না যায় এ ধারায়। সঞ্জয় মাথুর (রয়েল ব্যাংক অব স্কটল্যান্ডের প্রধান) বলেছেন, এখন থেকে বিনিময় হারের অস্থিরতার ক্ষেত্রে সতর্ক অবস্থানে থাকতে হবে কোম্পানিগুলোকে। তিনি আরও বলেছেন, এ সংক্রান্ত অস্থিরতা তখনই দেখা দেবে, যখন প্রতি মাসে ৮৫ বিলিয়ন ডলারের বন্ড ক্রয়ের প্রণোদনা থেকে সটকে পড়বে যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ বা ফেড। তবে ২০১৪ সালের শুরু থেকে ফিরে আসতে পারে কোম্পানিগুলোর ঝুঁকি। যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয়, ব্যাংক ফেডারেল রিজার্ভ প্রতি মাসে প্রায় ৮৫ বিলিয়ন ডলারের সরকারি বন্ড ক্রয় করে আসছে প্রবৃদ্ধি ও কর্মসংস্থান বাড়াতে। কমবেশি উন্নতি হয়েছে তাদের শ্রমবাজারে। ফলে তারা পরিকল্পনা করছে প্রণোদনা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নেয়ার। ডলারের সরবরাহ হ্রাস পাওয়ার আশংকায় মুদ্রাটির চাহিদা বেড়ে যায় সারা বিশ্বে। গত আগস্ট মাসে এশিয়ার মুদ্রাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় ছিল ভারতের মুদ্রা রুপি। এখনও রয়েছে কমবেশি খারাপ। দাম ধরে রাখতে নানামুখী পদক্ষেপ নেয় রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়া।
সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ১০ নভেম্বর ২০১৩

,

0 comments

আপনার মন্তব্য লিখুন