এমন সরকার বেছে নিতে হবে যারা গ্রামীণ ব্যাংকের মৌলিকতা রক্ষা করবে: ড. ইউনূস

নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, দেশের রাজনৈতিক সঙ্কটের কারণ এবং এর সমাধানের উপায় কি তা সকলেই জানেন, আমরাও জানি। কিন্তু এরপরও এই সঙ্কট সমাধানের দায়িত্ব যাদের, যারা এই সঙ্কট থেকে জাতিকে রক্ষা করতে পারেন তারা প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিচ্ছেন না। সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে দক্ষিণ এশিয়ার  দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ অগ্রগতি সত্ত্বেও সুস্থ রাজনৈতিক সংস্কৃতির অভাব আমাদের সার্বিক উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করছে। দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ নির্মাণ করতে হলে বর্তমানে প্রচলিত রাজনৈতিক চর্চা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। মার্কিন কংগ্রেসের সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার কংগ্রেশনাল গোল্ড মেডেল প্রাপ্তি উপলক্ষে যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী বাংলাদেশী আমেরিকানদের প্রদত্ত এক গণসংবর্ধনায় বক্তৃতাকালে তিনি এসব কথা বলেন। গতকাল সন্ধ্যায় নিউ ইয়র্কের লাগার্ডিয়া কলেজের পারফর্মিং আর্টস সেন্টারের থিয়েটার অডিটরিয়ামে নিউ ইয়র্কের বাংলাদেশী আমেরিকানরা ‘ইউএস প্রবাসী বাংলাদেশী নাগরিক সমাজ’-এর ব্যানারে এই সংবর্ধনার আয়োজন করে। সংবর্ধনায় উপস্থিত প্রায় ৭শ’ বাংলাদেশী আমেরিকানের বিপুল করতালি আর হর্ষধনির মধ্যে ড. ইউনূস বলেন, গত ৩০ বছরে দারিদ্র্যমুক্তি, নারীর ক্ষমতায়ন, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসহ মানব উন্নয়নের সবগুলো সূচকে ব্যাপক উন্নতি করেছে বাংলাদেশ। ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রমের মাধ্যমে বাংলাদেশের নারীদের মধ্যে যুগান্তকারী পরিবর্তন এসেছে। এর পেছনে গ্রামীণ ব্যাংকের ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রমের আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ভূমিকা রয়েছে। তিনি বলেন, গ্রামীণ ব্যাংকের ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রমের সাফল্যের অংশ হিসেবে বাংলাদেশ দারিদ্র্য দূরীকরণ বিষয়ক জাতিসংঘ সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিত সময়ের আড়াই বছর আগেই অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে। অথচ আপনারা  দেখেছেন বাংলাদেশে গ্রামীণ ব্যাংকের ওপর হামলা হয়েছে। এখন তাই সময় এসেছে, আমাদেরকে এমন একটি সরকার ব্যবস্থা বেছে নিতে হবে, যারা গ্রামীণ ব্যাংকের মতো সৃষ্টিশীল ও বিশ্বব্যাপী সমাদৃত প্রতিষ্ঠানের মৌলিকতাকে রক্ষা করবে। বক্তৃতায় বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দার প্রতি ইঙ্গিত করে মুনাফাকেন্দ্রিক অর্থ ব্যবস্থার জন্য পুঁজিবাদ বর্তমানে নিজেদের গ্যাঁড়াকলে আটকা পড়েছে বলে মন্তব্য করেন ডক্টর ইউনূস। তিনি বলেন, প্রচলিত ব্যবস্থার পুঁজিবাদী অর্থনীতি মানুষের দারিদ্র্যমুক্তির সমাধান দিতে পারছে না। ড. ইউনূস বলেন, ‘পুঁজিবাদের শ্রেষ্ঠ শহর এই নিউ ইয়র্কে ২০০৮ সালে গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠার পর এ পর্যন্ত এই শহরের ১৮ হাজার গ্রাহক ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রমে অংশ নিয়েছেন এবং তাদের সকলেই নারী। নিউ ইয়র্কে গ্রামীণ ব্যাংকের এই সাফল্যের ধারাবাহিকতায় লস অ্যানজেলেস, আইডাহো ও  নেব্রাস্কার মতো যুক্তরাষ্ট্রের অন্যান্য শহরেও গ্রামীণ ব্যাংকের ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম চালু হয়েছে এবং চাহিদা থাকায় আগামীতে মিশিগানসহ আরও কয়েকটি অঙ্গরাজ্যেও ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম চালু করবে গ্রামীণ ব্যাংক।’ এর অর্থ যুক্তরাষ্ট্রে গ্রামীণ ব্যাংক সাফল্য পেয়েছে। এটি একটি অনেক বড় ঘটনা। কেননা, এর মাধ্যমে বাংলাদেশের মতো তৃতীয় বিশ্বের একটি দেশের আইডিয়া যুক্তরাষ্ট্রের মতো পৃথিবীর একটি শ্রেষ্ঠ অর্থনীতির দেশে বাস্তবায়ন হচ্ছে। এছাড়াও বক্তৃতায় ড. ইউনুস তার সামাজিক ব্যবসার ধারণা নিয়েও কথা বলেন। সমপ্রতি মালয়েশিয়ায় অনুষ্ঠিত বিশ্ব সামাজিক ব্যবসা সম্মেলনে বিশ্বের ৫০টি দেশের সরকার অংশ নিয়ে একটি সামাজিক ব্যবসা তহবিল গঠন করেছেন বলে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘সামাজিক ব্যবসার’ ধারণা বিশ্বে যুগান্তকারী পরিবর্তন আনতে শুরু করেছে। সামাজিক ব্যবসা নিয়ে বিশ্বের দেশে দেশে ব্যাপক আগ্রহের শুরু হয়েছে। সামাজিক ব্যবসার ধারণা বাস্তবায়ন সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয়ে কোস্টারিকা ও উরুগুয়ে সরকারকে সহযোগিতা করার জন্য তিনি চলতি সপ্তাহে ল্যাটিন আমেরিকা সফর করছেন উল্লেখ করে ড. ইউনূস বলেন, পদ্ধতিগত জটিলতার জন্য যে কোন সরকারের পক্ষেই সব সমস্যার সমাধান করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। এই যেমন যুক্তরাষ্ট্রের সকল নাগরিকের স্বাস্থ্য সুবিধার জন্য  প্রেসিডেন্ট ওবামার যুগান্তকারী ধারণা ‘ওবামাকেয়ার’। এর যদি সম্পূর্ণ বাস্তবায়নও হয় তারপরও যুক্তরাষ্ট্রের ২৩ মিলিয়ন মানুষ স্বাস্থ্যবীমার আওতার বাইরে থাকবেন। তিনি বলেন, এ জন্য সকল সমস্যার সমাধানে সরকারের ওপর নির্ভরশীল না হয়ে সামাজিক ব্যবসার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানে এগিয়ে আসতে হবে । কেননা, সামাজিক ব্যবসায় একজন বিনিয়োগকারী শুধুমাত্র তার বিনিয়োগকৃত পুঁজি ফেরত নিতে পারেন, লভ্যাংশ থেকে আর  কোন অংশ তুলে নিতে পারেন না। সামাজিক ব্যবসা থেকে লাভকৃত মুনাফা নির্দিষ্ট সামাজিক সমস্যার সমাধানে কাজে লাগানো হয়। অনুষ্ঠানে নিউ ইয়র্ক প্রবাসী বাংলাদেশীদের বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন পর্যায়ক্রমে দীর্ঘসময় সারিবদ্ধভাবে লাইনে দাঁড়িয়ে নিজ নিজ সংগঠনের পক্ষ থেকে ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে ফুলের তোড়া ও ক্রেস্ট দিয়ে সম্ভাষণ জানান। অনুষ্ঠানে মানপত্র পাঠ করেন সাংবাদিক মনজুর আহমেদ। স্বাগত বক্তব্যে সংবর্ধনা কমিটির সদস্য সচিব সাংবাদিক আবু তাহের ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে বাংলাদেশের ‘আগামীদিনের স্বপ্নের রূপকার ও পথপ্রদর্শক’ বলে উল্লেখ করেন। অনুষ্ঠানের আহ্বায়ক অধ্যাপক শওকাত আলী তার বক্তব্যে গ্রামীণ ব্যাংকে সরকারি হস্তক্ষেপের কঠোর সমালোচনা করেন। অনুষ্ঠানের সভাপতি ও সংবর্ধনা কমিটির উপদেষ্টা ডা. মোহাম্মদ আনোয়ার মিঞা সামাজিক ব্যবসায় সাফল্যের স্বীকৃতিস্বরূপ আগামীতে ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার দেয়ার দাবি জানান। উল্লেখ্য, যুক্তরাষ্ট্র কংগ্রেসের ‘কংগ্রেশনাল গোল্ড  মেডেল’ প্রবর্তনের ৫০তম বার্ষিকী উদযাপন অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে যোগ দেয়ার জন্য ড. মুহাম্মদ ইউনূস বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে সফর করছেন। যুক্তরাষ্ট্রের স্থানীয় সময় বুধবার কংগ্রেসের সকালের অধিবেশনে অনুষ্ঠেয় এই উদযাপন অনুষ্ঠানে এ পর্যন্ত ‘কংগ্রেশনাল গোল্ড  মেডেল’প্রাপ্ত  সকল বরেণ্য ব্যক্তি উপস্থিত থাকবেন। 
সূত্র: দৈনিক মানবজমিন, ২১ নভেম্বর ২০১৩

,

0 comments

আপনার মন্তব্য লিখুন