আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য মারাত্মক সংকটে

অস্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও উপর্যুপরি টানা হরতালের কারণে মারাত্মক সংকটে পড়েছে দেশের আমদানি ও রপ্তানি বাণিজ্য। গত দুই সপ্তাহে ৬০ ঘন্টা করে দুই দফায় ৬ দিনের হরতালের রেশ কাটতে না কাটতেই বিরোধী দলীয় জোটের ডাকা টানা চার দিনের হরতাল চলছে সারাদেশে। একের পর এক দীর্ঘ হরতালের কারণে ব্যবসায়ী ও শিল্প উদ্যোক্তাদের নাভিঃশ্বাস চরমে উঠেছে। দিনরাত হরতাল থাকায় দেশের প্রধান সমুদ্র বন্দর চট্টগ্রাম থেকে একদিকে আমদানি করা পণ্য যেমন খালাস করা যাচ্ছে না। অপরদিকে রপ্তানির জন্য প্রস্তুত রাখা পণ্য কারখানার গোডাউনে বা বেসরকারি কন্টেইনার টার্মিনালগুলোতে (আইসিডি) পড়ে আছে। প্রতিকূল পরিস্থিতিতে কোন কোন উদ্যোক্তা নিজস্ব অর্থ ব্যয় করে আকাশপথে পণ্য পাঠাচ্ছেন। কাঁচামাল পরিবহন বন্ধ থাকায় অধিকাংশ কারখানায় উত্পাদনও ব্যাহত হচ্ছে।

শুধু আমদানি-রপ্তানি নয়, হরতালের কারণে অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যও ব্যাহত হচ্ছে। সরবরাহ না থাকায় কাঁচা বাজারগুলোতে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বেড়েই চলেছে। দেশের প্রধান পাইকারি বাজার চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জের গোডাউনগুলোতে আমদানি করা পণ্যের স্তূপ পড়ে আছে। সবসময় কর্মচঞ্চল খাতুনগঞ্জ এখন হরতালের কারণে নীরব-নিথর। খাতুনগঞ্জ ট্রেড এক ইন্ডাস্ট্রিজ এসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক ছগীর আহমদ ইত্তেফাককে বলেন, 'আমরা দেউলিয়া হওয়ার পর্যায়ে পৌঁছে যাচ্ছি। ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ হয়ে পড়ায় ব্যাংকের কাছে আমাদের দায়বদ্ধতা শুধুই বাড়ছে।'

এদিকে ব্যবসা-বাণিজ্য কার্যত বন্ধ থাকলেও ব্যবসায়ী ও শিল্প উদ্যোক্তাদের ঠিকই ব্যাংকের সুদ পরিশোধ করতে হচ্ছে নির্ধারিত হারে। কোন কোন প্রতিষ্ঠানের পক্ষে ব্যাংকের সুদ, কাঁচামালের টাকা এবং বেতন পরিশোধ করে কারখানা চালু রাখা দু:সাধ্য হয়ে পড়েছে।

সূত্রমতে, গতকাল সোমবার চট্টগ্রাম বন্দরে আমদানি করা পণ্যভর্তি ২৭ হাজারেরও বেশি কন্টেইনার পড়ে ছিল। এগুলোর অধিকাংশেই বিভিন্ন কারখানার কাঁচামাল। এছাড়া দেশের ১৬টি আইসিডিতে রপ্তানির জন্য প্রস্তুত করা হাজার হাজার কন্টেইনার জড়ো করে রাখা হয়েছে। বন্দরে আসা জাহাজগুলোকে অনেকটা পণ্য ছাড়াই ছেড়ে যেতে হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে বন্দর থেকে ছেড়ে যাওয়ার সময় বিলম্বিত করতে হচ্ছে। এতে করে জাহাজ মালিক কর্তৃপক্ষও ক্ষতিগ্রস্ত হতে হচ্ছে।

অস্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে গত তিন মাসে কন্টেইনার হ্যান্ডলিং শতকরা ৮ ভাগ কমে গেছে। বিশেষ করে দেশে আমদানির পরিমাণ উল্লেখযোগ্য হারে কমে গেছে।

চট্টগ্রাম কাস্টমসের পরিসংখ্যান অনুযায়ী চলতি অর্থবছরে গতকাল সোমবার পর্যন্ত চট্টগ্রাম কাস্টমস তার লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় প্রায় ৪০০ কোটি টাকা কম শুল্ক আদায় হয়েছে। চট্টগ্রাম কাস্টমসের ২০১৩-১৪ অর্থবছরের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ২৫ হাজার কোটি টাকা। বর্তমান পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে তা কোনভাবেই অর্জন সম্ভব নয় বলে সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা অভিমত ব্যক্ত করেন। চট্টগ্রামে ভ্যাট আদায়ও খুব নাজুক বলে জানা যায়।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা জানান, দেশে পণ্যের উত্পাদন ও বিক্রি না থাকলে ভ্যাট কোথা থেকে পাব। তিনি বলেন, তাদেরও লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সম্ভব হবে না। অনুরূপভাবে আমদানি-রপ্তানি কমে যাওয়ায় চট্টগ্রাম বন্দরের আয়ও নিম্নমুখী বলে জানা যায়।

তৈরি পোশাক খাতের উদ্যোক্তা এবং বিজিএমইএর সাবেক সহ-সভাপতি এবিএম সামছুদ্দিন হরতালে ব্যবসা-বাণিজ্যে প্রভাব সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেন, চলতি বছর এমনিতেই ব্যবসা ভালো যায়নি। তার ওপর হরতালসহ নানা অস্থিরতায় এখন সময় আরো খারাপ যাচ্ছে। তিনি বলেন, 'বর্তমান পরিস্থিতিতে আমরা ভবিষ্যতের জন্য কোন পরিকল্পনা করতে পারছি না। ক্রেতারা নানা ধরনের প্রশ্ন করছে। সেগুলোরও উত্তর দিতে পারছি না।'

আমদানিকৃত পণ্যসমূহ বন্দর থেকে খালাস করতে না পারায় পোর্ট চার্জ, শিপিং চার্জ দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে। এতে করে ব্যাংক সুদের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। ব্যবসায়ী নেতৃবৃন্দের মতে, ইতিমধ্যে অনেক ব্যবসায়ী খেলাপি হয়ে পড়েছে। একদিকে মার্কেটিং নেই। অপরদিকে উত্পাদন হরাস। ফলে ব্যাংকের ঋণ পরিশোধ করা যাচ্ছে না। দিনমজুর এবং স্বল্প আয়ের লোকজনের জীবিকা নির্বাহ দুর্বিষহ অবস্থায় পৌঁছেছে।
সূত্র: দৈনিক ইত্তেফাক, ১২ নভেম্বর ২০১৩

,

0 comments

আপনার মন্তব্য লিখুন