মার্জিন ঋণ এখন গলার কাঁটা


পুঁজিবাজারে মার্জিন ঋণ এখন গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। অতিমূল্যায়িত শেয়ার কিনে আটকে গেছে এসব ঋণ। অতিমূল্যায়িত শেয়ারের দরে এমন পতন হয়েছে যে, ওই শেয়ার বর্তমান বাজারদরে বিক্রি করা সম্ভব নয়। ওই শেয়ারগুলো বিক্রি করলে বাণিজ্যিক ব্যাংক এবং ব্রোকারেজ হাউসগুলোর প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা লোকসান হবে।
জানা যায়, আইন অনুযায়ী বাধ্যতামূলক বিক্রি (ফোর্সড সেল) না করায় গ্রাহককে দেয়া মার্জিন ঋণের উল্লেখযোগ্য অংশই অনাদায়ী হয়ে পড়েছে। ২০১০ সালের পুঁজিবাজার ধসে অনেক মার্চেন্ট ব্যাংক এবং ব্রোকারেজ হাউস বিনিয়োগকারীদের মানবিক দিক বিবেচনা করে বাধ্যতামূলক (ফোর্সড সেল) বিক্রি করেনি। ফলে আজ হাত-পা বাঁধা অবস্থায় দিন কাটাতে হচ্ছে তাদের। এ অবস্থায় মূলধন সঙ্কটে ভুগছে ঋণ প্রদানকারী অধিকাংশ প্রতিষ্ঠান। নতুন করে মূলধনের জোগান না পেলে ঋণ প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর বিপর্যয়ের মধ্যে পড়ার আশঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে। অন্যদিকে, শুধু লোকসানই নয়; বড় বড় বিনিয়োগকারীর পোর্টফোলিও নেগেটিভ হওয়ায় তারা অনেক দিন ধরেই অ্যাকাউন্টে কোনো লেনদেন করছেন না। ফলে ওই হিসাবগুলো নিয়ে বিপাকে রয়েছে মার্চেন্ট ব্যাংকগুলো। এমনই একটি শীর্ষ মার্চেন্ট ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা বলেন, সরকারের অনুরোধে আমরা ফোর্সড সেল করিনি। কিন্তু সরকার এখন আমাদের জন্য কিছুই করছে না। পুনঃতহবিলের কথা বলা হচ্ছে; কিন্তু তা তো বিনিয়োগকারীদের জন্য। তার হাউসের অনেক বিনিয়োগকারী এখন পর্যন্ত কোনো যোগাযোগ করছেন না। ফলে তহবিলের প্রভাব নেই বাজারে। তহবিলের চেয়ে বিনিয়োগকারীরা যদি বাজারে ফিরে আসতেন, সেটাই ভালো হতো। বিএসইসির তথ্যানুসারে, বর্তমানে পুঁজিবাজারে প্রায় ১৩ হাজার কোটি টাকার মার্জিন ঋণ রয়েছে। এরমধ্যে গ্রাহককে দেয়া বিভিন্ন ব্রোকারেজ হাউসের মার্জিন ঋণ প্রায় ৬ হাজার ৮০০ কোটি টাকা। অবশিষ্ট ৬ হাজার ২০০ কোটি টাকার ঋণ দিয়েছে মার্চেন্ট ব্যাংকগুলো।
জানা যায়, পুঁজিবাজারে ঋণ প্রদানকারী শীর্ষ ৫টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঋণ রয়েছে এআইবিএল ক্যাপিটাল মার্কেট সার্ভিসেস লিমিটেডের। গত ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটি প্রায় ৭৭০ কোটি টাকা মার্জিন ঋণ বিতরণ করে। পরের অবস্থানে রয়েছে প্রাইম ব্যাংক ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড। ব্যাংকটি ৬৭০ কোটি টাকার মার্জিন ঋণ দিয়েছে। আর এবি ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেডের ৬৪০ কোটি, পিএফআই সিকিউরিটিজের ৫৮০ কোটি এবং আইসিবি ক্যাপিটাল ম্যানেজমেন্ট লিমিটেডের ৫৮০ কোটি টাকার মার্জিন ঋণ রয়েছে। মানবিক বিষয় বিবেচনা করে অর্থমন্ত্রী ফোর্সড সেল করতে নিষেধ করেছিলেন। তবে লিখিতভাবে কোনো নির্দেশনা ছিল না। মৌখিক নির্দেশনায় ঋণ প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে বড় ধরনের সঙ্কটের মধ্যে ফেললেও এর কোনো আর্থিক দায় নিতে হয়নি সরকারকে। শুধু ক্ষতিগ্রস্ত বিনিয়োগকারীদের পুনর্বিনিয়োগের সহায়তার অংশ হিসেবে ৯০০ কোটি টাকার তহবিল গঠন করা হয়েছে। এরমধ্যে ৩০০ কোটি টাকা ছাড় হলেও শর্তের বেড়াজালে তা কেউই নিতে আগ্রহী নন। ওই তহবিলের অর্থ পেতে ঋণ প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে ২০১১ সালে দেয়া ঋণের সুদ মওকুফ করতে বলা হয়েছে। যদিও কিছু প্রতিষ্ঠান নিজ থেকেই ক্ষতিগ্রস্ত বিনিয়োগকারীদের সুদ মওকুফ করেছে। ক্ষতিগ্রস্ত বিনিয়োগকারীর ঋণ থেকে পাওয়া সুদ প্রতিষ্ঠানের সাসপেন্ড অ্যাকাউন্টে নেয়া ছাড়াও মার্ক-টু-মার্কেট পদ্ধতিতে ধীরে ধীরে ঋণ সমন্বয়ের চেষ্টা করছে কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান। তবে এসব প্রচেষ্টার কোনোটিই বর্তমান সঙ্কট উত্তরণে পুরোপুরি সহায়ক না হওয়ায় সরকারের দিকনির্দেশনার অপেক্ষায় রয়েছে প্রতিষ্ঠানগুলো। মার্জিন ঋণ বিধিমালার ৩(৫) উপধারা অনুযায়ী শেয়ারের দর কমার কারণে গ্রাহকের পোর্টফোলিও মূল্য ঋণের ১৫০ শতাংশ পর্যন্ত কমলে গ্রাহক নগদ অর্থ দিয়ে ঋণ সমন্বয় করবেন। অন্যথায় নতুন করে শেয়ার লেনদেন করতে পারবেন না। এমনকি ৩(৬) উপধারায় ঋণের ১২৫ শতাংশ দর কমলে ঋণ প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানকে গ্রাহকের সম্মতি ছাড়াই শেয়ার বিক্রির ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। আর ১৫০ শতাংশ দর হারানোর পর ফোর্সড সেল বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।
সূত্র: দৈনিক যায় যায় দিন, ১৮ নভেম্বর ২০১৩

0 comments

আপনার মন্তব্য লিখুন