সচেতন হচ্ছেন বিনিয়োগকারীরা

পুঁজিবাজারে দিন যত যাচ্ছে বিনিয়োগকারীদের মাঝে সচেতনতা ততই বাড়ছে। ফলে নানা ধরনের গুজব এড়িয়ে মৌলভিত্তিসম্পন্ন কোম্পানির শেয়ারে বিনিয়োগ করছেন তারা। পাশাপাশি আগের মতো শুধু স্বল্পমেয়াদের লাভ-লোকসানের কথা না ভেবে, দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ ভাবনাও আসছে তাদের মাঝে। আর এর প্রতিফলন ঘটছে লভ্যাংশের ক্ষেত্রে তাদের প্রতিক্রিয়ায়। কয়েক বছর আগেও বোনাস লভ্যাংশ বলতে অন্ধ ছিলেন প্রায় শতভাগ বিনিয়োগকারী। কিন্তু এখন তাদের বড় অংশই বোনাসের চেয়ে নগদ লভ্যাংশকে প্রাধান্য দিচ্ছে। তবে বিনিয়োগকারীদের সচেতনতা বাড়লেও অনেক কোম্পানির উদ্যোক্তা ও নীতিনির্ধারক এখনো পুরনো ধ্যান-ধারণাতেই আটকে আছেন। কোনো প্রয়োজন ছাড়াই এসব কোম্পানি বছরের পর বছর ধরে বোনাস লভ্যাংশ দিয়ে পরিশোধিত মূলধন বাড়িয়ে যাচ্ছেন। এ কারণে সামগ্রিকভাবে ব্যবসা ও মুনাফায় কাঙ্ক্ষিত প্রবৃদ্ধি হলেও শেয়ারপ্রতি আয় বা ইপিএস সেভাবে বাড়ছে না। আটকে থাকছে লভ্যাংশ বাড়ানোর সক্ষমতা। বিশ্লেষকরা মনে করেন, কোম্পানির ব্যবসা সম্প্রসারণ, নতুন ইউনিট স্থাপন বা আধুনিকায়নের জন্য বাড়তি মূলধনের দরকার পড়লে বোনাস বা স্টক লভ্যাংশ দিয়ে মূলধনভিত্তি সম্প্রসারণ করা যেতে পারে। কিন্তু এ ধরনের প্রয়োজন ছাড়া মূলধন বাড়ানো হলে তা কার্যত কোম্পানিটির জন্য বাড়তি বোঝা হয়ে দাঁড়াতে পারে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন বিশ্লেষক তালিকাভুক্ত দুটি কোম্পানি বিএটিবিসি ও মেঘনা পেট্রোলিয়ামের শেয়ার সংখ্যা, মুনাফা এবং ইপিএসের মধ্যে তুলনা দিয়ে তার বক্তব্যের যৌক্তিকতা তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। কোম্পানি দুটি পরিশোধিত মূলধনের আকার প্রায় কাছাকাছি। তিনি ৫ বছরের উপাত্ত বিশ্লেষণ করেছেন। ২০০৯ সালে খাদ্য খাতের কোম্পানি বিএটিবিসির পরিশোধিত মূলধন ছিল ৬০ কোটি টাকা। আর শেয়ার সংখ্যা ৬ কোটি। এখন পর্যন্ত কোম্পানিটির শেয়ার সংখ্যা বাড়েনি। কারণ, তারা বোনাস লভ্যাংশ বা রাইট ইস্যু করেনি। ২০০৯ সালে কোম্পানির নিট মুনাফা ছিল ২০৭ কোটি টাকা। চলতি বছরের প্রথম তিন প্রান্তিকে এটি ৩৪৪ কোটি টাকা মুনাফা করেছে।
অন্যদিকে ২০০৯ সালে মেঘনা পেট্রোলিয়ামের পরিশোধিত মূলধন ছিল ৪৬ কোটি ২০ লাখ টাকা। শেয়ার সংখ্যা ৪ কোটি ৬২ লাখ। গত ৪ বছরে বোনাস লভ্যাংশ দেয়ায় কোম্পানির মূলধনের পরিমাণ বেড়ে হয়েছে ৮১ কোটি ৯৮ লাখ টাকা। শেয়ার সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮ কোটি ১৯ লাখ। ২০০৯ সালে কোম্পানির মুনাফা ছিল মাত্র ৩৮ কোটি টাকা। ২০১৩ সালে তা বেড়ে হয় ১৮৭ কোটি টাকা। ৪ বছরের ব্যবধানে কোম্পানির মুনাফা বৃদ্ধি পায় ৩৯০ শতাংশ। কিন্তু একই সময় শেয়ারপ্রতি আয় বা ইপিএস বাড়ে মাত্র ১৭৭ শতাংশ। ২০০৯ সালে কোম্পানিটির ইপিএস ছিল ৯ টাকা, যা ২০১৩ সালে ২৫ টাকা হয়েছে। অন্যদিকে বিনিয়োগকারীরা কোম্পানির সক্ষমতার পাশাপাশি তাদের তাৎক্ষণিক প্রাপ্তির বিষয়টিকেও বিবেচনায় নিচ্ছেন। বিনিয়োগকারী এবিএম শহীদুল ইসলাম এ বিষয়ে বলেন, রেকর্ড তারিখের পর লভ্যাংশের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে বাজারে মূল্য সমন্বয় হয়। তিনি বলেন, যদি একটি কোম্পানির শেয়ারের দাম ২০০ টাকা হয়, আর এটি ২৫ শতাংশ বোনাস দেয়, তাহলে রেকর্ড তারিখের পর বাজারে সমন্বয়জনিত মূল্য দাঁড়ায় ১৫০ টাকা। ওই সময় বিনিয়োগকারী তার শেয়ার বিক্রি করেত চাইলে ১৫০ টাকাই পাবেন। বাকি টাকার জন্য বোনাস শেয়ার হিসাবে জমা না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। সাধারণত কোম্পানির বার্ষিক সাধারণ সভার (এজিএম) ২-৩ সপ্তাহ পর বোনাস শেয়ার জমা দেয়া হয়। আর রেকর্ড তারিখ থেকে শেয়ার জমা হওয়া পর্যন্ত প্রক্রিয়ায় সময় লেগে যায় ১ মাস থেকে ২ মাস পর্যন্ত। কিন্তু নগদ লভ্যাংশের ক্ষেত্রে তেমন মূল্য সমন্বয় হয় না বলে বিনিয়োগকারী চাইলেই রেকর্ড তারিখের পর শেয়ার বিক্রি করে পুরো টাকা তুলে নিতে পারেন।
বিনিয়োগকারীদের আচরণগত পরিপক্কতার কারণে যেসব কোম্পানি ভালো নগদ লভ্যাংশ দেয়, তাদের চাহিদা ও শেয়ারের দাম বাড়ছে। পাশাপাশি অতিমাত্রায় বোনাস-প্রবণ কোম্পানির শেয়ারের দাম লভ্যাংশের পর কমে যাচ্ছে। এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির শিক্ষক ও পুঁজিবাজার বিশ্লেষক হেলাল উদ্দিন বলেন, স্টক দিয়ে যদি ইপিএস কমে যায়, তাহলে স্টক দেয়ার কোনো মানে হয় না। তবে যদি কোম্পানি আরো বড় করতে চায়, বড় করলে যদি তাদের আয় বাড়ে, তাহলে স্টক দেয়াটা ভালো। কিন্তু মূলধন বড় হলেও যদি মুনাফা সে অনুপাতে না বাড়ে, তাহলে স্টক দেয়াই কোম্পানি ও বিনিয়োগকারী_ সবার জন্য লাভজনক। তিনি বলেন, ক্যাশ দিলে শেয়ারের সংখ্যা বা জোগান বাড়ে না। তাই শেয়ারের দামে এর ইতিবাচক প্রভাব পড়ে।
সূত্র: দৈনিক যায় যায় দিন, ১৪ নভেম্বর ২০১৩

0 comments

আপনার মন্তব্য লিখুন