এডিপি বাস্তবায়নে ৯ বাধা

নীতিমালা যথাযথভাবে অনুসরণ না করা এবং মন্ত্রণালয়ের চাহিদা আর এমটিবিএফ (মধ্যমেয়াদি বাজেট কাঠামোর) এর মধ্যে পার্থক্যসহ বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাস্তবায়নে নয়টি বাধা চিহ্নিত করেছে পরিকল্পনা কমিশন। সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের (জিইডি) সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে এসব বাধার বিষয় তুলে ধরা হয়েছে।

এছাড়া অন্য বাধাগুলোর মধ্যে রয়েছে- প্রকল্পের সংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি ও বাজেট নিয়ন্ত্রণে পরিকল্পনা কমিশনের অপর্যাপ্ত ক্ষমতা, উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) ও টেকনিক্যাল প্রকল্প প্রস্তাবে (টিপিপি) গুণগত মানের দুর্বলতা, ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা ও এডিপির মধ্যে দুর্বল সংযোগ, প্রকল্প পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়নে আইএমইডির সীমিত কর্তৃত্ব, ঘনঘন প্রকল্প সংশোধন, কর্মকর্তাদের ঘনঘন বদলি এবং দুর্বল আর্থিক ব্যবস্থাপনা ও জবাবদিহিতা।

এ বিষয়ে পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের (জিইডি) সদস্য ড. শামসুল আলম বলেন, দেশের উন্নয়নে সরকারি অর্থায়নের ক্ষেত্রে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) একটি বড় ভূমিকা পালন করে। পরিকল্পনা কমিশন এ এডিপি তৈরি ও বাস্তবায়নের দায়িত্বে নিয়োজিত। মধ্যমেয়াদি বাজেট কাঠামোর (এমটিবিএফ) আওতায় অর্থ বিভাগ এডিপির ওপর ভিত্তি করে বাৎসরিক বাজেট সিলিং নির্ধারণ করে। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলো উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব বা কারিগরি প্রকল্প প্রস্তাব প্রণয়ন এবং অনুমোদিত প্রকল্প বাস্তবায়ন করে থাকে। কিন্তু নানা সমস্যার কারণে প্রতি বছর এডিপির শতভাগ বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা যায় না।

তিনি বলেন, সম্পদ প্রাপ্তি ও অর্থনৈতিক সম্ভাব্যতার বিষয়গুলো বিবেচনা না করেই অনেক সময় রাজনৈতিক বিবেচনায় প্রতি বছর এডিপিতে নতুন প্রকল্প অর্নত্মভুক্ত করা হয়। অপর্যাপ্ত বরাদ্দের কারণে প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন মেয়াদকাল বৃদ্ধি পায়, যা প্রকল্পের প্রাক্কলিত ব্যয় বৃদ্ধি করে। এডিপি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে একটি দীর্ঘস্থায়ী সমস্যাই হচ্ছে প্রকল্পের প্রাক্কলিত ব্যয় ও মেয়াদ বৃদ্ধি এবং অপর্যাপ্ত বরাদ্দ প্রদান।

নীতিমালা যথাযথ অনুসরণ না করা : এ ক্ষেত্রে বলা হয়েছে নতুন প্রকল্প অন্তর্ভুক্তির সময় কার্যক্রম বিভাগ ষষ্ঠ পঞ্চমবার্ষিক পরিকল্পনার আলোকে একটি নীতিমালা জারি করে। কিন্তু প্রকল্পের অগ্রাধিকার প্রদানের ক্ষেত্রে এ নীতিমালা যাথাযথ অনুসরণ করা হয় না। ফলে অনেক সময় কম গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প বা গুরুত্বহীন বিপুলসংখ্যক প্রকল্প এডিপিতে অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে। এ কারণে এডিপির অর্থবরাদ্দ এবং বাস্তবায়ন পরবর্তী সময়ে সমস্যায় পড়ে।

মন্ত্রণালয়ের চাহিদা ও এমটিবিএফের মধ্যে পার্থক্য : এ ক্ষেত্রে বলা হয়েছে, প্রতি বছর মধ্যমেয়াদি বাজেট কাঠামোর আওতায় অর্থবিভাগ প্রত্যেক মন্ত্রণালয়ের জন্য বাজেট বরাদ্দের সিলিং নির্ধারণ করে। কিন্তু মন্ত্রণালয়ের চাহিদা অনুযায়ী বরাদ্দ প্রদান করা হয় না। যেহেতু অর্থ মন্ত্রণালয় প্রদেয় সিলিং মন্ত্রণালয়গুলোর তুলনায় কম, সেহেতু সব চলমান বা নতুন প্রকল্পের জন্য পর্যাপ্ত বরাদ্দ প্রদান করা সম্ভব হয় না। ফলে প্রকল্পের মেয়াদ ও প্রাক্কলিত ব্যয় বৃদ্ধি পায়। বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে অনেক সময় দীর্ঘসূত্রিতার কারণে প্রকল্পটি রুগ্ন ও মূল্যহীন হয়ে পড়ে। অধিক প্রকল্পের সংখ্যা ও বাজেট নিয়ন্ত্রণে পরিকল্পনা কমিশনের অপর্যাপ্ত ক্ষমতা : প্রতিবেদনে এ ক্ষেত্রে বলা হয়েছে, ১৯৯০ সাল থেকে পরিকল্পনা কমিশনের জনবল বৃদ্ধি পেলেও এ সময়ে অতিদ্রুত প্রকল্পের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। এডিপিতে ক্রমবর্ধমান প্রকল্পের সংখ্যা এবং বাজেটের ভারে পরিকল্পনা নিমজ্জিত। এ পরিপ্রেক্ষিতে সরকারি বিনিয়োগ বৃদ্ধির গুরুত্ব বিবেচনা করে পরিকল্পনা কমিশনের কর্মদক্ষতা বৃদ্ধির ওপরও গুরুত্ব দেয়া প্রয়োজন। ডিপিপি ও টিপিপির গুণগতমানের দুর্বলতা : এ ক্ষেত্রে বলা হয়েছে, সাধারণত উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) ও কারিগরি প্রকল্প প্রস্তাব (টিপিপি) কম দক্ষ জনবল দিয়ে প্রণয়ন করা হয়। এ দলিল মন্ত্রণালয়ের পরিকল্পনা উইংয়ে পরিবীক্ষণ করা হয়ে থাকে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে মন্ত্রণালয়ের পরিকল্পনা উইং প্রয়োজনের নিরিখে বা সময়ের স্বল্পতার কারণে যথাযথ পরিবীক্ষণ ছাড়াই প্রকল্প দলিল পরিকল্পনা কমিশনে পাঠিয়ে দেয়। প্রায়শ ঃ পরিকল্পনা কমিশন তদবির বা চাপের কারণে দ্রুত অনুমোদন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে। ফলে দুর্বল ডিপিপি বা টিপিপির কারণে তা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে অনেক বাধার সম্মুখীন হয়।

ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা ও এডিপির মধ্যে দুর্বল সংযোগ : এডিপিভুক্ত বেশি সংখ্যক প্রকল্পই ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার কোন বিষয়ের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ বা কোন উদ্দেশ্য অর্জন করতে চায়- এমন নির্দেশনা থাকে না। তাই ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার মেয়াদকালে গৃহীত সব প্রকল্পই এমনভাবে নির্বাচন করা উচিত যাতে প্রকল্পগুলো চলমান পরিকল্পনার কোন কৌশলের আলোকে বাস্তবায়িত হচ্ছে বা কোন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে চায় তা সুস্পষ্টভাবে থাকতে হবে।

আইএমইডির সীমিত কর্তৃত্ব : সরকারি প্রকল্পের মূল্যায়নকারী একমাত্র সংস্থা হচ্ছে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি)। এ সংস্থার পর্যবেক্ষণের ওপর প্রদত্ত সুপারিশমালা প্রয়োগের জন্য সরাসরি আইনগত কোন কার্যপদ্ধতি বা প্রকল্প কর্তৃপক্ষকে বাধ্য করার কোন ক্ষমতা নেই। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মন্ত্রণালয়গুলো আইএমইডির সুপারিশ বাস্তায়নে যথেষ্ট মনোযোগী নয়। এতে পরিবীক্ষণ কার্যক্রম অকার্যকর হয়ে পড়ে। এ ছাড়া এ বিভাগের সীমিত জনবল পরিবীক্ষণে বাধা হয়ে দাঁড়ায়।

ঘন ঘন প্রকল্পসংশোধন : কর্তৃপক্ষ যাতে ভার ও বোঝা মনে না করে এ জন্য ডিপিপিতে অনেক সময়ই আন্তর্জাতিক দাম হতে অনেক কম দামে ব্যয় প্রাক্কলন করা হয়। যাতে প্রকল্পটি এডিপিতে অন্তর্ভুক্তি সহজ হয়। পরবর্তী সময়ে রেটসিডিউল পরিবর্তন, নির্মাণ সামগ্রীর দাম বৃদ্দিসহ নানাভাবে বার বার প্রকল্পসংশোধন করা হয়। এছাড়া ভূমি অধিগ্রহণের সমস্যাতো আছেই। এসব কারণে প্রকল্প বাস্তবায়ন দেরি হয় এবং ব্যয় বেড়ে যায়।

কর্মকর্তাদের ঘন ঘন বদলি : বর্তমান সিভিল সার্ভিস চাকরির অনুশীলন হলো ঘন ঘন কর্মকর্তাদের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগে বদলি করা। গড়ে প্রতি তিন বছর সময় পরে একজন কর্মকর্তা বদলি হয়ে থাকে। ফলে একটি নির্দিষ্ট সেক্টরে কাজ করে পর্যাপ্ত জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা সঞ্চয় কঠিন হয়ে পড়ে। এ সীমিত জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার জন্য ওই নির্দিষ্ট সেক্টরের প্রকল্প বাস্তবায়ন এবং এডিপি প্রক্রিয়াকরণে দেরি হয়।

দুর্বল আর্থিক ব্যবস্থাপনা ও জবাবদিহিতা : প্রকল্প ব্যবস্থাপকদের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার জন্য প্রচলিত হিসাবরক্ষণ ও হিসাব নীরিক্ষা পদ্ধতিটি অকার্যকর ও পুরাতন হয়ে গেছে। আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য হিসাবরক্ষণ পদ্ধতি মেনে কাজ করা হয় না। অর্থনৈতিক সুশাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে একটি আন্তর্জাতিক মানসম্মত হিসাবরক্ষণ ও স্বচ্ছ পদ্ধতি প্রবর্তন করা জরুরি।
সূত্র: দৈনিক সংবাদ, ৭ জানুয়ারী ২০১৪

,

0 comments

আপনার মন্তব্য লিখুন