ব্যাংক আমানতে কমছে সুদের হার : ঋণ দেয়ার বেলায় বেশি

চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতার প্রভাব পড়ছে না ঋণের সুদ হারের ক্ষেত্রে। এ ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনাও উপেক্ষা করা হচ্ছে। ইতিমধ্যে বিনিয়োগ পরিস্থিতি ভয়াবহ হতাশাব্যঞ্জক পর্যায়ে চলে গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ হিসাবে, এ খাতে ৯০ হাজার কোটি টাকারও বেশি অলস অর্থ জমা হয়েছে। এ অবস্থায় ব্যাংকগুলো আমানতে আরেক দফা সুদহার কমিয়েছে। এতে ব্যাংকের স্বার্থ রক্ষা হলেও গ্রাহক পর্যায়ে ক্ষতির সম্মুখীন হতে হচ্ছেন। একদিকে ঋণগ্রহীতার ওপর ব্যাংক ১৭ থেকে সাড়ে ২০ শতাংশ হারে সুদ চাপিয়ে দিচ্ছে। এর সঙ্গে সার্ভিস চার্জের নামে নানা ধরনের চার্জ আরোপ করা হচ্ছে। অন্যদিকে ব্যাংকগুলো আমানতে সুদ হার আরেক দফা কমিয়েছে। ফলে ব্যাংকের টাকা অনুৎপাদনশীল খাতে চলে যাওয়ার আশংকা করা হচ্ছে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ যুগান্তরকে বলেন, আমানতে সুদ কমলে সাধারণ গ্রাহকদের মধ্যে সঞ্চয় প্রবণতা কমে আসার আশংকা থাকে। ঘন ঘন আমানতে সুদ হার কমানো হলে উচ্চ সুদের আশায় ব্যাংকবহির্ভূত অনুৎপাদনশীল বিশেষ করে ঝুঁকিপূর্ণ খাতে টাকা চলে যেতে পারে। তিনি বলেন, আমানতে সুদ নির্ধারণের বিষয়টি সাধারণভাবে মূল্যস্ফীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত। সাম্প্রতিক সময়ে মূল্যস্ফীতির হার বাড়ছে। এ অবস্থায় আমানতে সুদ হার কমানো ব্যাংকগুলোর উচিত হচ্ছে না।
এক মাসের ব্যবধানে মেয়াদি আমানতে আরেক দফা সুদহার কমিয়েছে রাষ্ট্রীয় মালিকানার সোনালী, জনতা, রূপালী ও অগ্রণী ব্যাংক। মেয়াদি আমানতের প্রতিটি ক্ষেত্রে সুদ কমিয়ে সর্বোচ্চ ১১ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে। নতুন বছরের প্রথমদিন থেকে আমানতে পুনর্নির্ধারিত সুদ কার্যকর করা হয়েছে। এর আগে নভেম্বরে এসব ব্যাংকে সব ধরনের মেয়াদি আমানতে সুদ হার কমানো হয়েছিল। ডিসেম্বরে বিশেষায়িত খাতের তিনটিসহ মোট ১৮ ব্যাংক সুদ হার কমিয়েছে। এর আগে ৪ নভেম্বর রাষ্ট্রীয় মালিকানার ব্যাংকগুলোর ব্যবস্থাপনা পরিচালকরা এক বৈঠকে মেয়াদি আমানতের প্রতিটি ক্ষেত্রে সুদ কমিয়ে সর্বোচ্চ সাড়ে ১১ শতাংশে নামিয়ে আনেন। ওই সময় বেসরকারি খাতের বেশ কয়েকটি ব্যাংকও সুদ হার কমিয়ে দেয়। ডিসেম্বরে সরকারি মালিকানার তিনটি বিশেষায়িত এবং বেসরকারি ও বিদেশি মালিকানার ১৫টি ব্যাংক সুদ হার কমিয়েছে। এতে সামগ্রিক ব্যাংক খাতে আমানতে সর্বোচ্চ সুদ সাড়ে ১১ শতাংশের নিচে নেমে এসেছে। ঋণের সুদ পুনর্নির্ধারণের লক্ষ্যে ব্যাংকগুলোর প্রধান নির্বাহীদের সংগঠন এবিবি চলতি মাসে একটি বৈঠক করবে বলে জানা গেছে। ব্যাংকগুলো আমানতে সুদ হার কমালেও ২০১১ সালের মাঝামাঝি সময় থেকে ২০১২ সালের শুরুর দিকে ছিল উল্টো চিত্র। ওই সময়ে বেশিরভাগ ব্যাংক আমানত নিতে অসম প্রতিযোগিতায় নেমেছিল। তখন ব্যাংকগুলো ঘোষণার তুলনায় বেশি সুদে আমানত সংগ্রহ শুরু করে। পরে ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীদের সংগঠন এবিবি এক বৈঠক করে সুদের হার নির্ধারণ করে দেয়া হয়। ব্যাংকাররা মেয়াদি আমানতে সর্বোচ্চ সুদ হার সাড়ে ১২ শতাংশ এবং শিল্পের মেয়াদি ঋণ ও চলতি মূলধনে সর্বোচ্চ সাড়ে ১৫ শতাংশ সুদ নেয়ার ঘোষণা দেন। তবে এ ঘোষণার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না বেশিরভাগ ব্যাংক। তারা নানা উপায়ে ঘোষণার বাইরে বেশি সুদে আমানত নিতে শুরু করে। বিষয়টি বাংলাদেশ ব্যাংকের এক বিশেষ পরিদর্শনে উঠে আসার পর সব ব্যাংকগুলোকে এ বিষয়ে সতর্ক করা হয়।
রাষ্ট্রায়ত্ত চার ব্যাংকের পুনর্নির্ধারিত সুদ হার অনুযায়ী, এক মাসের বেশি তবে ২ মাসের কম সময়ের জন্য নেয়া আমানতে সোনালী, জনতা ও অগ্রণী ব্যাংক সুদ হার সাড়ে ৯ শতাংশ থেকে কমিয়ে সাড়ে ৮ শতাংশ নির্ধারণ করেছে। রূপালী ব্যাংক এ ক্ষেত্রে ৯ শতাংশ সুদ দেবে। তিন মাস থেকে ৬ মাসের কম মেয়াদি আমানতে সব ব্যাংক ১০ শতাংশ থেকে সুদ কমিয়ে সাড়ে ৯ শতাংশ নির্ধারণ করেছে। ছয় মাস থেকে ১ বছরের কম সময়ের জন্য নেয়া আমানতে ১১ শতাংশ থেকে ১০ শতাংশে সুদ কমিয়ে আনা হয়েছে। এক বছর থেকে ৩ বছরের কম সময়ের জন্য নেয়া আমানতে সাড়ে ১১ শতাংশ থেকে সুদ নামিয়ে আনা হয়েছে ১১ শতাংশে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তৈরি করা অপর এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, অধিকাংশ ব্যাংক শিল্প উদ্যোক্তাদের কাছ থেকে ১৭ থেকে সাড়ে ২০ শতাংশ হারে সুদ নিচ্ছে। এর সঙ্গে কোনো কোনো ব্যাংক ঋণ প্রক্রিয়াকরণ ফির নামে অতিরিক্ত সার্ভিস চার্জ আদায় করছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওই প্রতিবেদন অনুযায়ী, বর্তমানে দীর্ঘমেয়াদি ও চলতি মূলধন ঋণে দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতের ঋণের সুদ হার সবচেয়ে বেশি। উচ্চ হারে সুদ গুনতে গিয়ে বেড়ে যাচ্ছে বিনিয়োগ ব্যয়। এর সঙ্গে বর্তমান হরতাল-অবরোধের ফলে শিল্প-কল-কারখানায় স্থবিরতা দেখা দিয়েছে। এতে বেড়ে যাচ্ছে উৎপাদন খরচও। যার প্রভাব পড়ছে ভোক্তাদের ওপরে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওই প্রতিবেদনে দেখা যায়, একদিকে ব্যাংকের বিনিয়োগ কমছে, অন্যদিকে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ক্রমাগত বাড়ছে। ২০১৩ সালের প্রথম প্রান্তিকে (জানুয়ারি-মার্চ) খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৫১ হাজার ২০ কোটি টাকা। দ্বিতীয় প্রান্তিকে (এপ্রিল-জুন) খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৫২ হাজার ৩০৯ কোটি টাকা। কিন্তু তৃতীয় প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের পরিমাণ এসে দাঁড়িয়েছে ৫৬ হাজার ৭২০ কোটি টাকায়। এতে দেখা যায়, প্রতি প্রান্তিকেই খেলাপি ঋণের পরিমাণ বাড়ছে। এ অবস্থার মধেও ঋণে সুদ হারের ক্ষেত্রে ২৩ ব্যাংক মানেনি কেন্দ্রীয় ব্যাংক নির্ধারিত সীমা।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদনে দেখা গেছে, নভেম্বর মাস শেষে ২৩ ব্যাংক স্প্রেড সীমা অতিক্রম করেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক গত মার্চ মাসের মধ্যে সব ব্যাংকের স্প্রেড সীমা ৫ শতাংশীয় পয়েন্টে নামিয়ে আনা সংক্রান্ত নির্দেশনা জারি করে। কিন্তু ৮ মাস পার হলেও সে নির্দেশনা মানেনি ২৩টি ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যানে দেখা যায়, নভেম্বর মাস শেষে ২৩টি ব্যাংকের স্প্রেড সীমা ৫ শতাংশের ওপরে রয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক ২০১২ সালের ২৭ জানুয়ারি প্রজ্ঞাপন জারি করে ২০১৩ সালের মার্চের মধ্যে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে স্প্রেড ৫ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনার নির্দেশ দেয়। এতে বলা হয়, যেসব ব্যাংকের স্প্রেড পাঁচ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনতে পারবে না তাদের বিরুদ্ধে কেন্দ্রীয় ব্যাংক রেগুলেটরি ব্যবস্থা নেবে। কিন্তু মার্চের পর ৮ মাস পেরিয়ে গেলেও তার কোনো প্রতিফলন দেখা যায়নি। পরিসংখ্যান মতে, বিদেশী ৯টি ব্যাংকের গড় স্প্রেড ৮.৪৮ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। যা অক্টোবর মাস শেষে ছিল ৮.৪৪ শতাংশ। এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকের। এ ব্যাংকটির স্প্রেড ১০.২১%। অন্যদিকে স্থানীয় বেসরকারি ৩৮ বাণিজ্যিক ব্যাংকের মধ্যের ১৬ ব্যাংক স্প্রেড নির্দেশনা পরিপালন করছে না বলে তথ্য দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
বাংলাদেশের অর্থনীতির সাম্প্রতিক পরিস্থিতি নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদনে দেখা গেছে, গত বছরের অক্টোবরে ব্যাংক ব্যবস্থায় প্রায় ৮০ হাজার কোটি টাকা এবং সেপ্টেম্বর শেষে ৭২ হাজার কোটি টাকার তারল্য উদ্বৃত্ত ছিল। আর নভেম্বরে শেষে উদ্বৃত্ত তারল্যের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৯০ হাজার ৭৩ কোটি ৭৩ লাখ টাকা। প্রতি মাসেই ব্যাংক ব্যবস্থায় প্রায় ৮ থেকে ১০ হাজার কোটি টাকা তারল্য উদ্বৃত্ত হচ্ছে। প্রতিবেদনে আরও দেখা যায়, ব্যাংকগুলোর কাছে সামগ্রিকভাবে নগদ অর্থ রয়েছে এক লাখ ৯১ হাজার ৭২৭ কোটি ৭০ লাখ টাকা। সে হিসাবে ব্যাংকিং খাতে মোট অর্থের ৩২ দশমিক ৪৩ শতাংশই উদ্বৃত্ত তারল্য। প্রচলিত বিধি মোতাবেক প্রত্যেক তফসিলি ব্যাংককে তাদের মোট পুঁজির ১৯ শতাংশ বাংলাদেশ ব্যাংকে নগদে এবং বন্ড আকারে জমা রাখতে হয়। অর্থাৎ প্রতি ১০০ টাকার বিপরীতে সর্বোচ্চ ৮১ টাকা পর্যন্ত বিনিয়োগ করতে পারবে ব্যাংকগুলো। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে ব্যাংকগুলো গড়ে ৭১ দশমিক ২৮ শতাংশ বিনিয়োগ করতে পারছে।
সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ৭ জানুয়ারী ২০১৪

,

0 comments

আপনার মন্তব্য লিখুন