ব্যবসা ব্যয় বাড়াচ্ছে ব্যাংক ঋণের সুদ

বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনার প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে ২২টি ব্যাংক ঋণ আমানতের সুদের ব্যবধান (স্প্রেড) শতাংশের ওপর রাখছে অথচ বাংলাদেশ ব্যাংক এক সার্কুলারের মাধ্যমে ব্যাংকগুলোকে নির্দেশ দিয়েছিল স্প্রেড শতাংশের নিচে রাখতে হবে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে যথাযথ তদারকি না করায় ব্যাংকগুলো নির্দেশনা পরিপালন করছে না এটা পরিপালন না করায় ব্যাংক ঋণের সুদের হার কমছে না এতে বেড়ে যাচ্ছে ব্যবসা ব্যয়
স্প্রেড বেশি ব্যাংকগুলোর মধ্যে ১৫টি বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংক, ৬টি বিদেশী ব্যাংক একটি সরকারি ব্যাংক রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, বিভিন্ন সময় ব্যাংকগুলোকে ঋণ আমানতের সুদের ব্যবধান শতাংশের নিচে নামিয়ে আনার নির্দেশনা দেয়া হয়েছিল। কিন্তু বেশির ভাগ ব্যাংকই নির্দেশনা মানছে না। ঋণ আমানতের সুদের হারের ব্যবধান নিয়ে তৈরি ৩০ সেপ্টেম্বরভিত্তিক বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদন মতে, বর্তমানে নতুন পুরনো মিলে মোট ৩৬টি বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকের মধ্যে ১৫টিরই ঋণ আমানতের সুদের ব্যবধান শতাংশের ওপরে রয়েছে।
এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি সুদের ব্যবধান রয়েছে ব্র্যাক ব্যাংকের দশমিক ১০ শতাংশ। ব্যাংকটির আমানতের গড় সুদ রয়েছে দশমিক ৫৪ শতাংশ, কিন্তু ঋণ দিয়ে গ্রাহকের কাছ থেকে সুদ নিচ্ছে গড়ে ১৬ দশমিক ৬৪ শতাংশ। দশমিক শূন্য শতাংশ সুদের ব্যবধান রয়েছে ডাচ-বাংলা ব্যাংকের। এছাড়া শতাংশের ওপরে বেশি স্প্রেড রয়েছে এমন অন্য ব্যাংকগুলোর মধ্যে রয়েছে এবি ব্যাংকের দশমিক ২৬ শতাংশ, সিটি ব্যাংকের দশমিক ৭৬ শতাংশ, আইএফআইসি ব্যাংকের দশমিক ৮২ শতাংশ, পূবালী ব্যাংকের দশমিক ৩৫ শতাংশ, উত্তরা ব্যাংকের দশমিক ৯৯ শতাংশ, ইস্টার্ন ব্যাংকের দশমিক ৪২ শতাংশ, প্রাইম ব্যাংকের দশমিক ৬৭ শতাংশ, সোস্যাল ইসলামী ব্যাংকের দশমিক ৫৩ শতাংশ, ওয়ান ব্যাংকের দশমিক ১৬ শতাংশ, বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের দশমিক ৯০ শতাংশ, প্রিমিয়ার ব্যাংকের দশমিক ২১ শতাংশ, ব্যাংক এশিয়ার দশমিক ৮৫ শতাংশ যমুনা ব্যাংক দশমিক ২৩ শতাংশ।
অপরদিকে ৯টি বিদেশী ব্যাংকের মধ্যে ৬টিরই ঋণ আমানতের সুদের ব্যবধান শতাংশের ওপরে রয়েছে। এর মধ্যে স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকের ১০ দশমিক ১৮ শতাংশ, সিটি ব্যাংক এনএ দশমিক ৪৭ শতাংশ, উরি ব্যাংকের দশমিক ৫৯ শতাংশ এবং এইচএসবিসি ব্যাংকের রয়েছে দশমিক ৯৪ শতাংশ। এছাড়া হাবিব ব্যাংকের সাড়ে শতাংশ, কমার্স ব্যাংক অব সিলনের দশমিক ৮৬ শতাংশ। এদিকে চার সরকারি ব্যাংকের মধ্যে রূপালী ব্যাংকের ঋণ আমানত সুদের ব্যবধান রয়েছে শতাংশের ওপরে।
জানা গেছে, গত ২০১১ সালের মার্চ বাংলাদেশ ব্যাংক গভর্নর . আতিউর রহমানের সভাপতিত্বে বাংলাদেশ ব্যাংকে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে ব্যাংক উদ্যোক্তাদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকস (বিএবি) ব্যাংকারদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ (এবিবি) প্রতিনিধিরা স্বপ্রণোদিত হয়ে বাংলাদেশ ব্যাংককে প্রতিশ্রতি দিয়েছিল ঋণ আমানতের সুদ হার ব্যবধান ৪টি ত্রৈমাসিকে গড়ে শতাংশে নামিয়ে আনা হবে। কিন্তু বেশিরভাগ ব্যাংকই প্রতিশ্রতি রক্ষা না করায় পরবর্তীতে বাংলাদেশ ব্যাংক এক সার্কুলার জারি করে ঋণ আমানতের সুদের ব্যবধান শতাংশের নিচে নামিয়ে আনার নির্দেশ দেয়।
এদিকে ওই বছরের শেষের দিকে আন্তর্জাতিক ঋণ বিতরণকারী সংস্থা আইএমএফের কাছ থেকে ঋণ পাওয়ার শর্ত হিসেবে উৎপাদনশীল খাতে সর্বোচ্চ সুদের হার প্রত্যাহার করে নেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এর আগে ৫টি উৎপাদনশীল খাতে সর্বোচ্চ সুদের হার ছিল ১৩ ভাগ। কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে তা প্রত্যাহার করার পর ব্যাংকগুলো অনেকটা ফ্রি স্টাইলে সুদের হার বাড়িয়ে দেয়। এসময় আমানতের সুদের হারও বাড়িয়ে সর্বোচ্চ ১৪ শতাংশে নেয়া হয়। ব্যবসায়ীদের আবেদনের প্রেক্ষিতে বাংলাদেশ ব্যাংক এফবিসিসিআই, ব্যাংকারদের শীর্ষ সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ (এবিবি) ব্যাংক উদ্যোক্তাদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকস (বিএবি) যৌথ সভা করে গত বছর ২৭ ফেব্রয়ারি। ওই সভায় শিল্প খাতের ব্যাংক ঋণের সর্বোচ্চ সুদের হার সাড়ে ১৫ ভাগ এবং আমানতের সর্বোচ্চ সুদের হার সাড়ে ১২ ভাগে নামিয়ে আনার সিদ্ধান্ত হয়। একই সঙ্গে ঋণ আমানতের সুদের হার ব্যবধান শতাংশের নিচে নামিয়ে আনার নির্দেশনা পরিপালন করতে ব্যাংকগুলোকে সতর্ক করা হয়।
কিন্তু এরপর থেকে আর যথাযথ তদারকি না করায় ব্যাংকগুলো অনেকটা ফ্রি স্টাইলে গ্রাহকদের কাছ থেকে সুদ আদায় করছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের কিছুটা নমনীয় নীতিও দায়ী বলে মনে করছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। তাদের মতে, শিল্প খাতের সর্বোচ্চ সুদের হার বেঁধে দেয়া হলেও ক্ষুদ্র মাঝারি শিল্পকে (এসএমই) নির্দেশনার বাইরে রাখা হয়েছে। এদিকে, এসএমইতে বেশি পরিমাণ ঋণ দিতে উৎসাহিত করতে সাধারণ প্রভিশন সংরক্ষণের হার কমিয়ে শূন্য দশমিক ২৫ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়েছে। অথচ আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী, সাধারণ প্রভিশন সংরক্ষণের হার ন্যূনতম শতাংশ রাখার বিধান রয়েছে।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, একদিকে তদারকির অভাব, অপরদিকে এসএমইকে ছাড় দেয়ায় ব্যাংকগুলোর বিতরণকৃত বেশিরভাগ ঋণই এখন এসএমই ঋণ হিসেবে দেখানো হচ্ছে। এতে ব্যাংকগুলো দুই দিক থেকে লাভবান হচ্ছে। একদিকে ব্যাংকগুলো অনেকটা ফ্রি স্টাইলে গ্রাহকদের কাছ থেকে এসএমই ঋণের বিপরীতে সুদ আদায় করছে। পাশাপাশি এসএমই ঋণ বেশি দেখানোর ফলে সাধারণ প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হচ্ছে তুলনামূলকভাবে কম পরিমাণ। এতে এক শ্রেণীর ব্যাংকের মুনাফা বেড়ে গেলেও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সাধারণ মানুষ। ঋণের সুদের হার না কমায় ব্যবসা ব্যয় কমছে না। এতে পণ্যের উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় উদীয়মান মূল্যস্ফীতিকে আরও উসকে দিচ্ছে।
সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ০৩ নভেম্বর, ২০১৩

,

0 comments

আপনার মন্তব্য লিখুন