যেমন অর্থনীতি রেখে যাচ্ছে সরকার
বর্তমান মহাজোট
সরকারের ক্ষমতা
হস্তান্তর কেবল
এখন
সময়ের
অপেক্ষা। এই
দীর্ঘ
প্রায়
পাঁচ
বছরে
রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব নিয়ে
মহাজোট
দেশের
আর্থ-সামাজিক অবস্থার কতটা উন্নয়ন ঘটাতে
সমর্থ
হয়েছে-
এই
নিয়ে
এখনই
বিভিন্ন পর্যবেক্ষক মহলে
গভীর
বিচার-বিশ্লেষণ শুরু হয়েছে। হিসাব
কষতে
শুরু
করেছেন
সচেতন
নাগরিক
সমাজ
ও
ভোটাররাও। দায়িত্ব নেয়ার
আগে
দীর্ঘমেয়াদে সরকারের পরিকল্পিত অর্থনৈতিক উন্নয়নের রূপরেখা এবং
লক্ষ্য
ও
উদ্দেশ্যের কৌশলগত
দলিল
হিসেবে
সরকারের নির্বাচনী ইশতেহারে ‘পরিপ্রেক্ষিত পরিকল্পনা ২০১০-২১ এর কথা
বলা
হয়েছে।’
এতে
২০২১
সালের
মধ্যে
এমন
এক
বাংলাদেশ গড়ার
স্বপ্ন
দেখিয়েছে মহাজোট
সরকার,
যেখানে
বাংলাদেশের ‘প্রতিটি নাগরিকের উন্নত
জীবনযাপন, শিক্ষার সুযোগ,
সামাজিক ন্যায়বিচারের সুফল
প্রাপ্তি এবং
সমতাভিত্তিক এক
আর্থসামাজিক পরিবেশ
নিশ্চিত করার
কথা
বলা
হয়েছে।
এছাড়া
দারিদ্র্য নিরসন,
মূল্যস্ফীতি প্রশমন,
অভ্যন্তরীণ ও
বাহ্যিক স্থিতিশীলতা রক্ষার
উপযোগী
প্রবৃদ্ধি সহায়ক
একটি
সমষ্টিক অর্থনৈতিক কাঠামোর কথাও
নির্বাচনী ইশতেহারে জোরালোভাবে বলা
হয়েছে।
ওই
ইশতেহারের প্রস্তাবনা অনুযায়ী মহাজোট
সরকারের মূল
লক্ষ্য
ছিল
জিডিপি
প্রবৃদ্ধি ২০১৫
সালের
মধ্যে
৮
শতাংশ
এবং
২০২১
সালের
মধ্যে
১০
শতাংশে
উন্নীত
করা
এবং
২০২১
সালের
মধ্যে
মাথাপিছু দারিদ্র্যের হার
১৩.৫ শতাংশে নামিয়ে
আনা।
লক্ষ্য অর্জনে পদক্ষেপ : এ লক্ষ্যসমূহ অর্জনের জন্য সরকার অগ্রাধিকারভিত্তিতে যেসব পদক্ষেপ গ্রহণ এবং বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করেছে সে বিষয়ে অর্থমন্ত্রণালয়ের সামষ্টিক অর্থনীতি বিভাগ দাবি করেছে, এ লক্ষ্যে সরকার-ব্যাপকভিত্তিক প্রবৃদ্ধি অর্জন ও খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ, বিশ্বায়ন ও আঞ্চলিক সহায়তা, উন্নয়ন ও সার্বিক কল্যাণে জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ, জ্ঞানভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠা, সুদৃঢ় অবকাঠামো বিনির্মাণ, কার্যকর সুশাসন নিশ্চিতকরণ, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব প্রশমন, সচেতন ও সংবেদনশীল সমাজ গঠন, সৃজনশীলতার বিকাশ এবং ডিজিটাল বাংলাদেশ গঠন প্রক্রিয়া অব্যাহত রেখেছে। সামষ্টিক অর্থনীতি বিভাগ আরও দাবি করেছে, আগামীর বাংলাদেশের জন্য সম্ভাবনার ক্ষেত্রগুলো বেশ প্রশস্ত ও আলোকোজ্জ্বল। রফতানি আয়ে স্থিতিশীলতা, ভৌত ও সামাজিক অবকাঠামোখাতে বর্ধিত বিনিয়োগ, সহস াব্ধের লক্ষ্য পূরণে মানব পুঁজি গঠনে অগ্রগতি, তথ্য প্রযুক্তির বিস্তৃত ব্যবহার, সামষ্টিক অর্থনৈতিক পরিপক্কতা, সর্বোপরি গতিশীল অভ্যন্তরীণ অর্থনীতির কল্যাণে ভিশন-২১ এর দ্বারপ্রান্তে এখন কড়া নাড়ছে বাংলাদেশ।
অপরদিকে সরকারের পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগ (জেইডি) কর্তৃক প্রণীত সর্বশেষ এক প্রতিবেদনে দেশের অর্থনীতির গতি-প্রকৃতির বিচার-বিশ্লেষণ, সামষ্টিক অর্থনীতির হাল হকিকত নিয়ে স্থিতিশীল ও কোনোও কোনোও ক্ষেত্রে গতিশীল অবস্থার কথা জানানো হয়েছে। ওই প্রতিবেদনের মাধ্যমে বুঝানোর চেষ্টা করা হয়েছে অতীতের যে কোনোও সরকারের শাসনামল থেকে মহাজোট সরকারের পাঁচ বছরের শাসনামলে দেশের আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনতে সক্ষম হয়েছে।
আগামী অর্থনীতির জন্য শংকা : এ ব্যাপারে সরকারের মধ্যমেয়াদি সামষ্টিক অর্থনেতিক নীতি বিবৃতিতে দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক অর্জন নিয়ে সন্তোষ প্রকাশের পাশাপাশি আগামী অর্থনীতির গতিপথ সচল রাখার বিষয়ে চরম শংকাও ব্যক্ত করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রার পথে বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে সংকটের জায়গাটি হল বেসরকারি বিনিয়োগের হারকে পরিপ্রেক্ষিত পরিকল্পনার নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার কাছাকাছি নিয়ে যাওয়া। কিন্তু সর্বাত্মক প্রচেষ্টা সত্ত্বেও সামগ্রিক পরিবেশ বেসরকারি বিনিয়োগের কাম্য আবহ তৈরিতে এখনও সমর্থ হয়নি সরকার। প্রত্যাশিতমাত্রার বিনিয়োগ সঞ্চালনে ঘাটতি ছাড়াও অন্য যে বিষয়গুলো আগামীতে দেশের প্রবৃদ্ধির হ্রাস টেনে ধরতে পারে তার ম্যধ্যে উল্লেখযোগ্য হল-শিল্পকারখানার কর্মপরিবেশ উন্নয়ন ও শ্রমিক অধিকার বিষয়ে আমদানিকারক ও ভোক্তাদের মধ্যে সাম্প্রতিক উদ্বেগ এবং শিল্পখাতে তার সম্ভাব্য অভিঘাত। এছাড়া বিদ্যুৎ উৎপাদনে দীর্ঘস্থায়ী একটি সমাধানে না পৌঁছানো, জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ, অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতা রক্ষা, অবকাঠামোখাতের বিপুল বিনিয়োগ চাহিদা, বাজেট বাস্তবায়ন, শ্রমিকের দক্ষতা বৃদ্ধি কিংবা সুশাসনের জন্য প্রাতিষ্ঠানিক উন্নয়নের মতো বিদ্যমান চ্যালেঞ্জগুলো আগামী সরকারের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনার ক্ষেত্রে শংকার কারণ হয়ে দাঁড়াবে।
অর্জন নিয়ে অর্থমন্ত্রীর স্বস্তি : ক্ষমতাসীন সরকারের দায়িত্বশীল অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত মহাজোট সরকারের প্রায় পাঁচ বছরের শাসনামল নিয়ে স্বস্তি প্রকাশ করে বলেছেন, সংকট আর সম্ভাবনার মাপকাঠিতে পরবর্তী সরকারের জন্য তারা একটি স্থিতিশীল ও সমৃদ্ধশালী অর্থনীতি রেখে যাচ্ছেন। একই সঙ্গে পরবর্তী সরকারের অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণে একটি সুষ্ঠু দিক-নির্দেশনাও দিয়ে যাচ্ছেন। তিনি দাবি করেন, বর্তমান সরকারের আমলে অর্থনীতির প্রায় প্রতিটি সূচকই ইতিবাচক অবস্থায় রয়েছে। গত চার বছরে গড়ে ৬ দশমিক ৩ শতাংশ হারে জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে। স্থানীয় সম্পদ আহরণের ক্ষেত্রে সরকার অভাবনীয় সাফল্য অর্জন করেছে। পাঁচ বছরে রাজস্ব আদায় তিন গুণ বেড়েছে। ট্যাক্স-জিডিপি অনুপাত ১০ দশমিক ৮ শতাংশ থেকে বেড়ে ১৩ দশমিক ৫ শতাংশ হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ১৭ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়েছে। সাড়ে ১০ বিলিয়ন ডলারের রফতানি আয় প্রায় তিনগুণ বেড়ে ২৭ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে। আমদানি ব্যয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩১ বিলিয়ন ডলারে। এ সময়ে মাথাপিছু আয়কে ১০৪৪ ডলারে উন্নীতকরণ, জনগণের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধিকল্পে কর্মসংস্থানসহ ব্যাপকভিত্তিক পদক্ষেপ গ্রহণ, শিল্পায়নের স্বার্থে করণীয় উদ্যোগ গ্রহণ, ব্যাপকভিত্তিক বৈদেশিক বিনিয়োগ আকর্ষণের মাধ্যমে প্রথমবারের মতো এফডিআই এক বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গত অর্থবছরে ১ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলারে উন্নীতকরণ, আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যমূল্য ঊর্ধ্বগতি সত্ত্বেও মূল্যস্ফীতি ৭ শতাংশের মধ্যে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা, ৪ হাজার মেগাওয়াট বৃদ্ধির মাধ্যমে বিদ্যুতে অভাবনীয় সাফল্য অর্জন, বিশ্বমন্দা সত্ত্বেও দেশীয় অভ্যন্তরীণ অর্থনীতি সচল রাখা, সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ ও দারিদ্র্য কমিয়ে ২৮.৫ শতাংশে নামিয়ে আনা, ব্যবসা-বাণিজ্যে গতিশীলতা আনয়নসহ শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও খাদ্যনিরাপত্তায় অভাবনীয় সাফল্য অর্জন করতে সক্ষম হয় বর্তমান সরকার। অর্থমন্ত্রী দাবি করছেন, বর্তমান সরকারের সাফল্যের এসব কর্মকাণ্ড ও কৃতিত্ব নিন্দুকরাও অস্বীকার করতে পারবে না। এতটা উন্মুক্ত, স্থিতিশীল, সমৃদ্ধশালী অর্থনীতি অতীতে কখনোই দেখা যায়নি।
পরবর্তী সরকারের জন্য অর্থমন্ত্রীর পরামর্শ : অর্থমন্ত্রী দেশের বিদ্যমান উন্নয়নের ধারা আগামীতেও অব্যাহত রাখার বিষয়ে কিছু সীমাবদ্ধতার কথা জানিয়ে তা মধ্যমেয়াদি লক্ষ্য পূরণে কিছু নীতি কৌশল চিহ্নিত করে আগামীর সরকারকে সেগুলো বাস্তবায়নের ওপর সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়ার পরামর্শ রাখেন। তিনি বলেন, গুরুত্বপূর্ণ খাতে সরবরাহ সীমাবদ্ধতা দূরীকরণ, কৃষি ও শিল্পখাতের উন্নয়ন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, কর সংস্কার কার্যক্রম অব্যাহত রাখা, রাজস্ব প্রশাসন শক্তিশালীকরণ, সরকারি অর্থ ও ঋণ ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন, ব্যাংক ও আর্থিক খাতে পরিচালন পদ্ধতির উন্নতি সাধন, জনমিতিক সুবিধা গ্রহণের লক্ষ্যে মানব সম্পদ উন্নয়ন, প্রযুক্তিনির্ভর কর্মকাণ্ডের প্রসার (ডিজিটাইজেশন), বাণিজ্যিক ও প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার কার্যক্রমসমূহ ত্বরান্বিত করার মাধ্যমে ব্যবসা ও বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশের উন্নয়ন, নারী উন্নয়ন ও সামাজিক নিরাপত্তা কার্যক্রমের প্রসার এবং দূরদর্শী মুদ্রা ও বিনিময় হার নীতি গ্রহণ ও কৌশল বাস্তবায়ন সম্ভব হলে ও বৈশ্বিক পরিস্থিতির অনুকূলে সুবিধা নিয়ে মধ্যমেয়াদে প্রবৃদ্ধি ও অন্যান্য অর্থনৈতিক চলকের আশাবাদী দৃশ্যকল্প অর্জন সম্ভব হতে পারে। এসব অর্জন সমৃদ্ধির পথে বাংলাদেশকে আরও একধাপ এগিয়ে নিয়ে যাবে বলে তিনি মনে করেন।
অর্থনীতি ‘ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে’ : বিরোধী শিবির থেকে বিভিন্ন সভা-সমাবেশে প্রায়শ দাবি করা হচ্ছে মহাজোটের প্রায় পাঁচ বছরের শাসনামলে দেশের অর্থনীতি ‘ধ্বংস’ হয়ে গেছে। এ সময়ে ব্যাংকিং ব্যবস্থা বিশৃংখলা, হলমার্ক ও বিসমিল্লাহ গ্র“পের মতো আলোচিত ঋণ কেলেংকারি, নির্বাচনী ইশতেহারে প্রাধান্য থাকাসত্ত্বেও ক্ষমতার শেষ সময়ে এসেও পদ্মা সেতুর ব্যাপারে দেশের জনগণকে এখনও আশার কথা শোনাতে ব্যর্থ হওয়া, পক্ষপাত দুষ্ট মন্ত্রী ও আমলাদের বিরুদ্ধে কঠোর না হওয়া, রেলওয়ের নিয়োগ কেলেংকারি, বিশ্বব্যাংকসহ অন্যান্য দাতাদের অর্থ ছাড়করণের ক্ষেত্রে চরম ব্যর্থতা, শিক্ষাঙ্গনে ছাত্রলীগের নৈরাজ্য, বিভিন্ন কর্পোরেশন ও মন্ত্রণালয়গুলোতে ক্ষমতাসীন দলের অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীদের অব্যাহত টেন্ডারবাজি ও চাঁদাবাজিসহ নানা কীর্তিকলাপই ছিল বর্তমান মহাজোট সরকারের আমলের উল্লেখযোগ্য এবং আলোচিত কর্মকাণ্ড। যার খেসারত সরকারকে নির্বাচনের মাধ্যমে মোকাবেলা করতে হবে বলে দাবি করা হচ্ছে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের শিল্পবিষয়ক উপদেষ্টা ও সাবেক জ্বালানি সচিব মোশাররফ হোসেন জানান, পাঁচ বছরে মহাজোট সরকার দেশের অর্থনীতিকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গেছে। দৃশ্যমান উন্নয়ন ঘটাতে তারা পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে। বিনিয়োগ কমে গেছে। অভ্যন্তরীণ সঞ্চয়ে ধস নেমেছে। শিল্পায়ন উপযোগী পরিবেশ তৈরি করতে পারেনি সরকার। নতুন শিল্প প্রতিষ্ঠা হচ্ছে না। এ কারণে বিনিয়োগকারীরা অন্য দেশে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। বিদ্যুৎ ও জ্বালানিখাতে অনিশ্চয়তা তো থেকেই যাচ্ছে। কৃষিতে প্রবৃদ্ধি কমে গেছে। রাজস্ব নীতি ও মুদ্রানীতির যাঁতাকলে সাধারণের নাভিশ্বাস বাড়ছে। সব মিলিয়ে মহাজোট সরকারে অর্জনের চেয়ে ব্যর্থতার পাল্লা অনেক বেশি ভারি।
অর্থনীতিবিদের প্রতিক্রিয়া : সাফল্য-ব্যর্থতার মাপকাঠিতে অর্থনীতিবিদদের পর্যবেক্ষণ ও বিচার-বিশ্লেষণ এক্ষেত্রে মিশ্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করা হয়েছে। তারা দাবি করছেন, সরকার দেশের সার্বিক অর্থনীতি ও আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থাকে উল্লেখযোগ্য কর্মকাণ্ডের মধ্যদিয়ে অপর সম্ভাবনার দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছেন বটে। বিভিন্ন ক্ষেত্রে সরকারের অনেক ঈর্ষণীয় অর্জনও রয়েছে। তবে নানা বিতর্ক ও ব্যর্থতা আর সুশাসন প্রতিষ্ঠার চরম অভাববোধের কারণে সরকারের এসব অর্জনকে ম্লান করে দিয়েছে। এক্ষেত্রে বিদ্যমান পরিস্থিতিও সামাল দিতে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে সরকার। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) অনারারি ফেলো ড. দেব প্রিয় ভট্টাচার্য অর্থনীতির পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করতে গিয়ে বলেন, সার্বিক অর্থনীতি সুবিধা ও অসুবিধার মিশ্রণ প্রক্রিয়ায় ভেতর দিয়ে এগুচ্ছে। তিনি বর্তমান অর্থনীতির চ্যালেঞ্জগুলো উল্লেখ করে বলেন, চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ কমছে, ব্যক্তি বিনিয়োগ কমছে, রেমিটেন্সের প্রবাহ কমছে, মূল্যস্ফীতি আবারও বাড়ছে, বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন ভালো হচ্ছে না। বর্তমান সরকারের আমলে বিদ্যমান রাজনৈতিক অস্থিরতার চ্যালেঞ্জ ও এর সম্ভাব্য ক্ষতিকর প্রভাব আগামী সরকার ও সামনের দিনগুলোতেও মোকাবেলা করতে হবে। চলতি অর্থ বছরে জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার ৬ শতাংশের নিচে হবে। নির্বাচনীয় বছর হিসেবে এ বছর বাজেট ঘাটতি বাড়বে ও সরকারের ব্যয় বৃদ্ধি পাবে। রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগের পতন হবে।
কর আহরণও কমবে। তিনি বলেন, গ্যাস উৎপাদনের অগ্রগতি নেই। যে টুকু উৎপাদন বেড়েছে সেটি শিল্প খাতে যাচ্ছে না। অক্টোবর থেকে ৮ হাজার ৫শ’ মেগাওয়াট উৎপাদন হওয়ার কথা। কিন্তু বর্তমান চাহিদা হচ্ছে ৬ হাজার ৪শ’ মেগাওয়াট। চাহিদার বিরাট অংশ বিদ্যুৎ পাওয়া যাচ্ছে না। অসংখ্য শিল্প ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে চালুর অপেক্ষায় আছে। কিন্তু গ্যাস সংযোগের কারণে তারা চালু করতে পারছে না। অথচ রাজনৈতিক ক্ষমতার বলে ফ্লাটের ফ্লাটে গ্যাস সংযোগ দেয়া হচ্ছে। গ্যাস সংযোগ নিয়ে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক খেলা চলছে। উৎপাদনশীল খাতে চলছে স্থবিরতা। ড. দেব প্রিয় তথ্য উপাত্ত তুলে ধরে বলেন, আমদানি ও রফতানি দুটোই বেড়েছে। তবে ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ কমেছে। বিনিয়োগ বোর্ডে নিবন্ধনের হিসাবে সম্প্রতি ১৪ শতাংশ কমেছে।
ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ অচল অবস্থায় রয়েছে। অথচ ব্যাংকগুলোতে ৮২ হাজার ৩৪৬ কোটি টাকা পড়ে আছে। দেশীয় উদ্যোক্তারা নিজস্ব ব্যাংক ব্যবস্থা বাদ দিয়ে বিদেশ থেকে এ পর্যন্ত এক হাজার কোটি ডলার ঋণ নিয়েছে। এর একমাত্র কারণ ব্যাংকগুলোতে সুদের হার বেশি। অস্বচ্ছ ও দুর্নীতিতে ব্যাংক ব্যবস্থাপনা ভেঙে পড়েছে। অপরদিকে রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে আগামীতে মূল্যস্ফীতি আবারও বৃদ্ধির আশংকা করেন সিপিডির এই ফেলো।
লক্ষ্য অর্জনে পদক্ষেপ : এ লক্ষ্যসমূহ অর্জনের জন্য সরকার অগ্রাধিকারভিত্তিতে যেসব পদক্ষেপ গ্রহণ এবং বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করেছে সে বিষয়ে অর্থমন্ত্রণালয়ের সামষ্টিক অর্থনীতি বিভাগ দাবি করেছে, এ লক্ষ্যে সরকার-ব্যাপকভিত্তিক প্রবৃদ্ধি অর্জন ও খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ, বিশ্বায়ন ও আঞ্চলিক সহায়তা, উন্নয়ন ও সার্বিক কল্যাণে জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ, জ্ঞানভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠা, সুদৃঢ় অবকাঠামো বিনির্মাণ, কার্যকর সুশাসন নিশ্চিতকরণ, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব প্রশমন, সচেতন ও সংবেদনশীল সমাজ গঠন, সৃজনশীলতার বিকাশ এবং ডিজিটাল বাংলাদেশ গঠন প্রক্রিয়া অব্যাহত রেখেছে। সামষ্টিক অর্থনীতি বিভাগ আরও দাবি করেছে, আগামীর বাংলাদেশের জন্য সম্ভাবনার ক্ষেত্রগুলো বেশ প্রশস্ত ও আলোকোজ্জ্বল। রফতানি আয়ে স্থিতিশীলতা, ভৌত ও সামাজিক অবকাঠামোখাতে বর্ধিত বিনিয়োগ, সহস াব্ধের লক্ষ্য পূরণে মানব পুঁজি গঠনে অগ্রগতি, তথ্য প্রযুক্তির বিস্তৃত ব্যবহার, সামষ্টিক অর্থনৈতিক পরিপক্কতা, সর্বোপরি গতিশীল অভ্যন্তরীণ অর্থনীতির কল্যাণে ভিশন-২১ এর দ্বারপ্রান্তে এখন কড়া নাড়ছে বাংলাদেশ।
অপরদিকে সরকারের পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগ (জেইডি) কর্তৃক প্রণীত সর্বশেষ এক প্রতিবেদনে দেশের অর্থনীতির গতি-প্রকৃতির বিচার-বিশ্লেষণ, সামষ্টিক অর্থনীতির হাল হকিকত নিয়ে স্থিতিশীল ও কোনোও কোনোও ক্ষেত্রে গতিশীল অবস্থার কথা জানানো হয়েছে। ওই প্রতিবেদনের মাধ্যমে বুঝানোর চেষ্টা করা হয়েছে অতীতের যে কোনোও সরকারের শাসনামল থেকে মহাজোট সরকারের পাঁচ বছরের শাসনামলে দেশের আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনতে সক্ষম হয়েছে।
আগামী অর্থনীতির জন্য শংকা : এ ব্যাপারে সরকারের মধ্যমেয়াদি সামষ্টিক অর্থনেতিক নীতি বিবৃতিতে দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক অর্জন নিয়ে সন্তোষ প্রকাশের পাশাপাশি আগামী অর্থনীতির গতিপথ সচল রাখার বিষয়ে চরম শংকাও ব্যক্ত করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রার পথে বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে সংকটের জায়গাটি হল বেসরকারি বিনিয়োগের হারকে পরিপ্রেক্ষিত পরিকল্পনার নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার কাছাকাছি নিয়ে যাওয়া। কিন্তু সর্বাত্মক প্রচেষ্টা সত্ত্বেও সামগ্রিক পরিবেশ বেসরকারি বিনিয়োগের কাম্য আবহ তৈরিতে এখনও সমর্থ হয়নি সরকার। প্রত্যাশিতমাত্রার বিনিয়োগ সঞ্চালনে ঘাটতি ছাড়াও অন্য যে বিষয়গুলো আগামীতে দেশের প্রবৃদ্ধির হ্রাস টেনে ধরতে পারে তার ম্যধ্যে উল্লেখযোগ্য হল-শিল্পকারখানার কর্মপরিবেশ উন্নয়ন ও শ্রমিক অধিকার বিষয়ে আমদানিকারক ও ভোক্তাদের মধ্যে সাম্প্রতিক উদ্বেগ এবং শিল্পখাতে তার সম্ভাব্য অভিঘাত। এছাড়া বিদ্যুৎ উৎপাদনে দীর্ঘস্থায়ী একটি সমাধানে না পৌঁছানো, জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ, অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতা রক্ষা, অবকাঠামোখাতের বিপুল বিনিয়োগ চাহিদা, বাজেট বাস্তবায়ন, শ্রমিকের দক্ষতা বৃদ্ধি কিংবা সুশাসনের জন্য প্রাতিষ্ঠানিক উন্নয়নের মতো বিদ্যমান চ্যালেঞ্জগুলো আগামী সরকারের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনার ক্ষেত্রে শংকার কারণ হয়ে দাঁড়াবে।
অর্জন নিয়ে অর্থমন্ত্রীর স্বস্তি : ক্ষমতাসীন সরকারের দায়িত্বশীল অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত মহাজোট সরকারের প্রায় পাঁচ বছরের শাসনামল নিয়ে স্বস্তি প্রকাশ করে বলেছেন, সংকট আর সম্ভাবনার মাপকাঠিতে পরবর্তী সরকারের জন্য তারা একটি স্থিতিশীল ও সমৃদ্ধশালী অর্থনীতি রেখে যাচ্ছেন। একই সঙ্গে পরবর্তী সরকারের অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণে একটি সুষ্ঠু দিক-নির্দেশনাও দিয়ে যাচ্ছেন। তিনি দাবি করেন, বর্তমান সরকারের আমলে অর্থনীতির প্রায় প্রতিটি সূচকই ইতিবাচক অবস্থায় রয়েছে। গত চার বছরে গড়ে ৬ দশমিক ৩ শতাংশ হারে জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে। স্থানীয় সম্পদ আহরণের ক্ষেত্রে সরকার অভাবনীয় সাফল্য অর্জন করেছে। পাঁচ বছরে রাজস্ব আদায় তিন গুণ বেড়েছে। ট্যাক্স-জিডিপি অনুপাত ১০ দশমিক ৮ শতাংশ থেকে বেড়ে ১৩ দশমিক ৫ শতাংশ হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ১৭ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়েছে। সাড়ে ১০ বিলিয়ন ডলারের রফতানি আয় প্রায় তিনগুণ বেড়ে ২৭ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে। আমদানি ব্যয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩১ বিলিয়ন ডলারে। এ সময়ে মাথাপিছু আয়কে ১০৪৪ ডলারে উন্নীতকরণ, জনগণের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধিকল্পে কর্মসংস্থানসহ ব্যাপকভিত্তিক পদক্ষেপ গ্রহণ, শিল্পায়নের স্বার্থে করণীয় উদ্যোগ গ্রহণ, ব্যাপকভিত্তিক বৈদেশিক বিনিয়োগ আকর্ষণের মাধ্যমে প্রথমবারের মতো এফডিআই এক বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গত অর্থবছরে ১ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলারে উন্নীতকরণ, আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যমূল্য ঊর্ধ্বগতি সত্ত্বেও মূল্যস্ফীতি ৭ শতাংশের মধ্যে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা, ৪ হাজার মেগাওয়াট বৃদ্ধির মাধ্যমে বিদ্যুতে অভাবনীয় সাফল্য অর্জন, বিশ্বমন্দা সত্ত্বেও দেশীয় অভ্যন্তরীণ অর্থনীতি সচল রাখা, সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ ও দারিদ্র্য কমিয়ে ২৮.৫ শতাংশে নামিয়ে আনা, ব্যবসা-বাণিজ্যে গতিশীলতা আনয়নসহ শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও খাদ্যনিরাপত্তায় অভাবনীয় সাফল্য অর্জন করতে সক্ষম হয় বর্তমান সরকার। অর্থমন্ত্রী দাবি করছেন, বর্তমান সরকারের সাফল্যের এসব কর্মকাণ্ড ও কৃতিত্ব নিন্দুকরাও অস্বীকার করতে পারবে না। এতটা উন্মুক্ত, স্থিতিশীল, সমৃদ্ধশালী অর্থনীতি অতীতে কখনোই দেখা যায়নি।
পরবর্তী সরকারের জন্য অর্থমন্ত্রীর পরামর্শ : অর্থমন্ত্রী দেশের বিদ্যমান উন্নয়নের ধারা আগামীতেও অব্যাহত রাখার বিষয়ে কিছু সীমাবদ্ধতার কথা জানিয়ে তা মধ্যমেয়াদি লক্ষ্য পূরণে কিছু নীতি কৌশল চিহ্নিত করে আগামীর সরকারকে সেগুলো বাস্তবায়নের ওপর সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়ার পরামর্শ রাখেন। তিনি বলেন, গুরুত্বপূর্ণ খাতে সরবরাহ সীমাবদ্ধতা দূরীকরণ, কৃষি ও শিল্পখাতের উন্নয়ন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, কর সংস্কার কার্যক্রম অব্যাহত রাখা, রাজস্ব প্রশাসন শক্তিশালীকরণ, সরকারি অর্থ ও ঋণ ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন, ব্যাংক ও আর্থিক খাতে পরিচালন পদ্ধতির উন্নতি সাধন, জনমিতিক সুবিধা গ্রহণের লক্ষ্যে মানব সম্পদ উন্নয়ন, প্রযুক্তিনির্ভর কর্মকাণ্ডের প্রসার (ডিজিটাইজেশন), বাণিজ্যিক ও প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার কার্যক্রমসমূহ ত্বরান্বিত করার মাধ্যমে ব্যবসা ও বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশের উন্নয়ন, নারী উন্নয়ন ও সামাজিক নিরাপত্তা কার্যক্রমের প্রসার এবং দূরদর্শী মুদ্রা ও বিনিময় হার নীতি গ্রহণ ও কৌশল বাস্তবায়ন সম্ভব হলে ও বৈশ্বিক পরিস্থিতির অনুকূলে সুবিধা নিয়ে মধ্যমেয়াদে প্রবৃদ্ধি ও অন্যান্য অর্থনৈতিক চলকের আশাবাদী দৃশ্যকল্প অর্জন সম্ভব হতে পারে। এসব অর্জন সমৃদ্ধির পথে বাংলাদেশকে আরও একধাপ এগিয়ে নিয়ে যাবে বলে তিনি মনে করেন।
অর্থনীতি ‘ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে’ : বিরোধী শিবির থেকে বিভিন্ন সভা-সমাবেশে প্রায়শ দাবি করা হচ্ছে মহাজোটের প্রায় পাঁচ বছরের শাসনামলে দেশের অর্থনীতি ‘ধ্বংস’ হয়ে গেছে। এ সময়ে ব্যাংকিং ব্যবস্থা বিশৃংখলা, হলমার্ক ও বিসমিল্লাহ গ্র“পের মতো আলোচিত ঋণ কেলেংকারি, নির্বাচনী ইশতেহারে প্রাধান্য থাকাসত্ত্বেও ক্ষমতার শেষ সময়ে এসেও পদ্মা সেতুর ব্যাপারে দেশের জনগণকে এখনও আশার কথা শোনাতে ব্যর্থ হওয়া, পক্ষপাত দুষ্ট মন্ত্রী ও আমলাদের বিরুদ্ধে কঠোর না হওয়া, রেলওয়ের নিয়োগ কেলেংকারি, বিশ্বব্যাংকসহ অন্যান্য দাতাদের অর্থ ছাড়করণের ক্ষেত্রে চরম ব্যর্থতা, শিক্ষাঙ্গনে ছাত্রলীগের নৈরাজ্য, বিভিন্ন কর্পোরেশন ও মন্ত্রণালয়গুলোতে ক্ষমতাসীন দলের অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীদের অব্যাহত টেন্ডারবাজি ও চাঁদাবাজিসহ নানা কীর্তিকলাপই ছিল বর্তমান মহাজোট সরকারের আমলের উল্লেখযোগ্য এবং আলোচিত কর্মকাণ্ড। যার খেসারত সরকারকে নির্বাচনের মাধ্যমে মোকাবেলা করতে হবে বলে দাবি করা হচ্ছে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের শিল্পবিষয়ক উপদেষ্টা ও সাবেক জ্বালানি সচিব মোশাররফ হোসেন জানান, পাঁচ বছরে মহাজোট সরকার দেশের অর্থনীতিকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গেছে। দৃশ্যমান উন্নয়ন ঘটাতে তারা পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে। বিনিয়োগ কমে গেছে। অভ্যন্তরীণ সঞ্চয়ে ধস নেমেছে। শিল্পায়ন উপযোগী পরিবেশ তৈরি করতে পারেনি সরকার। নতুন শিল্প প্রতিষ্ঠা হচ্ছে না। এ কারণে বিনিয়োগকারীরা অন্য দেশে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। বিদ্যুৎ ও জ্বালানিখাতে অনিশ্চয়তা তো থেকেই যাচ্ছে। কৃষিতে প্রবৃদ্ধি কমে গেছে। রাজস্ব নীতি ও মুদ্রানীতির যাঁতাকলে সাধারণের নাভিশ্বাস বাড়ছে। সব মিলিয়ে মহাজোট সরকারে অর্জনের চেয়ে ব্যর্থতার পাল্লা অনেক বেশি ভারি।
অর্থনীতিবিদের প্রতিক্রিয়া : সাফল্য-ব্যর্থতার মাপকাঠিতে অর্থনীতিবিদদের পর্যবেক্ষণ ও বিচার-বিশ্লেষণ এক্ষেত্রে মিশ্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করা হয়েছে। তারা দাবি করছেন, সরকার দেশের সার্বিক অর্থনীতি ও আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থাকে উল্লেখযোগ্য কর্মকাণ্ডের মধ্যদিয়ে অপর সম্ভাবনার দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছেন বটে। বিভিন্ন ক্ষেত্রে সরকারের অনেক ঈর্ষণীয় অর্জনও রয়েছে। তবে নানা বিতর্ক ও ব্যর্থতা আর সুশাসন প্রতিষ্ঠার চরম অভাববোধের কারণে সরকারের এসব অর্জনকে ম্লান করে দিয়েছে। এক্ষেত্রে বিদ্যমান পরিস্থিতিও সামাল দিতে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে সরকার। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) অনারারি ফেলো ড. দেব প্রিয় ভট্টাচার্য অর্থনীতির পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করতে গিয়ে বলেন, সার্বিক অর্থনীতি সুবিধা ও অসুবিধার মিশ্রণ প্রক্রিয়ায় ভেতর দিয়ে এগুচ্ছে। তিনি বর্তমান অর্থনীতির চ্যালেঞ্জগুলো উল্লেখ করে বলেন, চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ কমছে, ব্যক্তি বিনিয়োগ কমছে, রেমিটেন্সের প্রবাহ কমছে, মূল্যস্ফীতি আবারও বাড়ছে, বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন ভালো হচ্ছে না। বর্তমান সরকারের আমলে বিদ্যমান রাজনৈতিক অস্থিরতার চ্যালেঞ্জ ও এর সম্ভাব্য ক্ষতিকর প্রভাব আগামী সরকার ও সামনের দিনগুলোতেও মোকাবেলা করতে হবে। চলতি অর্থ বছরে জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার ৬ শতাংশের নিচে হবে। নির্বাচনীয় বছর হিসেবে এ বছর বাজেট ঘাটতি বাড়বে ও সরকারের ব্যয় বৃদ্ধি পাবে। রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগের পতন হবে।
কর আহরণও কমবে। তিনি বলেন, গ্যাস উৎপাদনের অগ্রগতি নেই। যে টুকু উৎপাদন বেড়েছে সেটি শিল্প খাতে যাচ্ছে না। অক্টোবর থেকে ৮ হাজার ৫শ’ মেগাওয়াট উৎপাদন হওয়ার কথা। কিন্তু বর্তমান চাহিদা হচ্ছে ৬ হাজার ৪শ’ মেগাওয়াট। চাহিদার বিরাট অংশ বিদ্যুৎ পাওয়া যাচ্ছে না। অসংখ্য শিল্প ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে চালুর অপেক্ষায় আছে। কিন্তু গ্যাস সংযোগের কারণে তারা চালু করতে পারছে না। অথচ রাজনৈতিক ক্ষমতার বলে ফ্লাটের ফ্লাটে গ্যাস সংযোগ দেয়া হচ্ছে। গ্যাস সংযোগ নিয়ে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক খেলা চলছে। উৎপাদনশীল খাতে চলছে স্থবিরতা। ড. দেব প্রিয় তথ্য উপাত্ত তুলে ধরে বলেন, আমদানি ও রফতানি দুটোই বেড়েছে। তবে ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ কমেছে। বিনিয়োগ বোর্ডে নিবন্ধনের হিসাবে সম্প্রতি ১৪ শতাংশ কমেছে।
ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ অচল অবস্থায় রয়েছে। অথচ ব্যাংকগুলোতে ৮২ হাজার ৩৪৬ কোটি টাকা পড়ে আছে। দেশীয় উদ্যোক্তারা নিজস্ব ব্যাংক ব্যবস্থা বাদ দিয়ে বিদেশ থেকে এ পর্যন্ত এক হাজার কোটি ডলার ঋণ নিয়েছে। এর একমাত্র কারণ ব্যাংকগুলোতে সুদের হার বেশি। অস্বচ্ছ ও দুর্নীতিতে ব্যাংক ব্যবস্থাপনা ভেঙে পড়েছে। অপরদিকে রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে আগামীতে মূল্যস্ফীতি আবারও বৃদ্ধির আশংকা করেন সিপিডির এই ফেলো।
সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ০৩ নভেম্বর, ২০১৩
০৩ নভেম্বর, ২০১৩
0 comments
আপনার মন্তব্য লিখুন