ব্যবসায়ীদের ত্রাতা মোদি!

ভারতের নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন কিছুতেই মানতে পারছেন না যে, গুজরাটের অর্থমন্ত্রী ও উগ্র হিন্দুবাদী দল বিজেপির নেতা নরেন্দ্র মোদি ভারতের প্রধানমন্ত্রী হবেন। অথচ দেশটির নয়া উদারবাদী অর্থনীতির একান্ত অনুষঙ্গ যে ব্যবসায়ী সমাজ, তার বড় অংশই কামনা করছে মোদি প্রধানমন্ত্রী হন এবং গতিহারা অর্থনীতিকে সচল করুন।
আর সব দেশের মতো ভারতের রাজনীতির সঙ্গে শিল্পকারখানা ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলোর সম্পর্ক বেশ নিবিড়। ২০১৪ সালে অনুষ্ঠেয় লোকসভা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ব্যবসায়ীরা এখন থেকেই নতুন করে হিসাব কষতে শুরু করেছেন। সম্প্রতি ‘দ্য ইকোনমিক্স’-এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রাজনীতিতে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলোর প্রচুর লগ্নি থাকে। এ ক্ষেত্রে ঐতিহাসিকভাবে বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো কংগ্রেসকে এবং ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা ভারতীয় জনতা পার্টিকে (বিজেপি) সমর্থন দিয়ে আসছে।
হালে বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো মোদির প্রতি যে প্রসন্ন ভাব দেখাচ্ছে, তা কিন্তু খুব বেশি দিন আগের নয়। ২০০২ সালে গুজরাটে মুসলিমবিরোধী দাঙ্গায় কয়েক হাজার মানুষ প্রাণ হারায়। সে সময় মুখ্যমন্ত্রী মোদি দাঙ্গা বন্ধে বা দোষীদের চিহ্নিত করে শাস্তি দেওয়ার ক্ষেত্রে দায়িত্বে অবহেলা করেছেন, এ কথা বলে বড় করপোরেটগুলো মোদির তীব্র সমালোচনা করেছিল। কিন্তু এখন মোদি তাদের কাছে ঝিম-ধরা শয়তান নয়, ত্রাতা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন।
গত দুই মেয়াদে কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন প্রগতিশীল সংযুক্ত মোর্চা (ইউপিএ) ভারতীয় অর্থনীতিকে গতিশীল করার ক্ষেত্রে অক্ষমতা প্রকাশ করেছে। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ইউপিএ সরকার সর্বদাই ‘ধীরে চলো নীতি’ অনুসরণ করেছে। এ কারণে আসছে নির্বাচনে নরেন্দ্র মোদির ওপর আস্থা রাখতে চাইছে বণিক সমাজ। তারা মনে করে, মোদিই পারেন ভারতের অর্থনীতির চাকাকে সচল করতে। এ সম্পর্কে এক শিল্পপতির বক্তব্য, ‘ভারতীয় অর্থনীতি ধ্বংসের মুখে, আমরা মোদির জন্য অপেক্ষা করছি।’
বণিক সমাজ এখন মনে করছে, মোদির নেতৃত্বে গুজরাটে যেভাবে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঘটেছে, বাকি ভারতের উন্নয়নের জন্যও একই ধরনের পদক্ষেপ চাই। মোদির শাসনকালে গুজরাট ভারতের শিল্প ক্ষেত্রে সবচেয়ে দ্রুত বিকাশমান রাজ্যে পরিণত হয়েছে। যদিও সমালোচকেরা মনে করেন, ওই সময় গুজরাটে ধনী-দরিদ্রের মধ্যে ব্যবধান বেড়েছে। গরিবদের অবস্থা আরও খারাপ হয়েছে। অথচ ব্যবসায়ীরা দেখছেন মোদির আমলে রাস্তা ও বন্দরের উন্নয়ন, বিদ্যুতের সহজলভ্যতা ও লাল ফিতার দৌরাত্ম্য কমে যাওয়াসহ বেশ কিছু বিষয়কে। এ জন্য তাঁরা সমর্থন করছেন মোদিকে। ব্যবসায়ীরা মনে করছেন, মোদিই হলেন সেই যোগ্য লোক, যিনি পুরো প্রশাসনকে সঙ্গে নিয়ে কাজ করতে পারবেন।
কংগ্রেসের শাসনামলে ভারতের অর্থনৈতিক সংস্কার কর্মসূচির গতি ছিল ধীর। এ সময় বেসরকারি বাণিজ্যিক বিনিয়োগ ১০ শতাংশের নিচে নেমে আসে। অথচ ২০০৮ সালের মার্চে তা ছিল ১৪ শতাংশেরও বেশি।
এর বাইরে আরও কয়েকটি কারণে সরকার ও ব্যবসায়ীদের মধ্যে আস্থায় চিড় ধরে। এই সময়ে অনেক ব্যবসায়ী পুলিশি হয়রানির শিকার হন। ১৫ অক্টোবরে বিড়লা শিল্পগোষ্ঠীর প্রধান কুমার মঙ্গলম বিড়লাকে কয়লাখনি কেলেঙ্কারির মামলায় জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। যদিও তিনি ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করে আসছেন।
অনেকে মনে করছেন, ইউপিএ জোটের সংস্কারকাজের ফলে অর্থনীতি আবার গতি পাচ্ছে। ২০১০ সালের পর রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত এমন ৭৫টি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের শেয়ার ৫০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে।
টাটার এক কর্মকর্তা যুক্তি দিয়ে বলেছেন, দুর্নীতিমুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলো এখন আর অনুকূল অবস্থায় নেই। তবে পুরো অর্থনীতির মধ্যে বিশৃঙ্খলা বিরাজ করছে। দেউলিয়া প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যাংক থেকে ঋণ সুবিধা পাচ্ছে না। টেলিকম শিল্পের ওপর নিয়ন্ত্রণ ভেঙে পড়েছে। ঝুঁকিপূর্ণ প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যবসা করা আরও কঠিন হয়ে গেছে। এ অবস্থায় প্রয়োজন নতুন বিধান ও আইনকানুন, যাতে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলো আবার লাভজনক হয়ে উঠতে পারে।
ব্যবসায়ীদের আশা, মোদি ব্যবসা-বান্ধবনীতি অনুসরণ করবেন। তিনি তাঁর প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করবেন বলেও বণিক সমাজ আশাবাদী। ভারতের সবচেয়ে বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠান টাটা সন্সের মালিক রতন টাটা মোদির নীতিকে সমর্থন জানিয়েছেন। পশ্চিমবঙ্গে কলকাতার অদূরে সিঙ্গুরে টাটার ন্যানো গাড়ি কারখানা স্থাপনের পরিকল্পনা ভেস্তে যাওয়ার পর মোদি রতন টাটাকে কারখানাটি গুজরাটে স্থাপনের জন্য আমন্ত্রণ জানিয়ে খুদে বার্তা পাঠিয়েছিলেন। ভারতের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি মুকেশ আম্বানিও মোদির ব্যবসা-বান্ধবনীতির প্রশংসা করেছেন। যদিও তাঁদের ব্যবসা ১৯৮০ দশকে কংগ্রেস আমলে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে মোদির দক্ষতাই গুজরাটে ফোর্ড ও জেনারেল মোটরসের মতো প্রতিষ্ঠানকে কারখানা স্থাপন করতে উত্সাহিত করেছে। অনেকে মনে করছেন, মোদি ভারতের ‘মার্গারেট থ্যাচার,’ যিনি ক্ষমতায় গেলে শেয়ারবাজার রাতারাতি ২০ শতাংশ পর্যন্ত প্রবৃদ্ধি অর্জন করবে।
ভারতের ব্যবসায়ী সমাজ মনে করে, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সমস্যাগুলো সমাধানে মোদি সফল হবেন। অনেকে মনে করেন, মোদি ভারতকে গুজরাটের মতো করে চালাতে পারবেন। কিন্তু জোটগত রাজনীতির কারণে ভারতে তাঁর নীতিগুলো বাস্তবায়ন করা সহজ হবে না। তবে অর্থনীতির প্রয়োজনে হয়তো তিনি দ্রুত সিদ্ধান্ত নেবেন এবং উচ্চাকাঙ্ক্ষী অর্থনৈতিক সংস্কারগুলোতে মনোযোগ দেবেন।
ব্যবসায়ীরা মনে করছেন, মোদি প্রশাসনে গতি ফেরানোর সঙ্গে সঙ্গে অর্থনীতির অভ্যন্তরীণ সংঘাত ও লাল ফিতার দৌরাত্ম্য দূর এবং গ্রহণযোগ্য আইন প্রণয়ন করবেন। মোদির কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে ব্যবসায়ী সমাজ আরও বেশি আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠবে, এ আকাঙ্ক্ষা এখন ভারতের মহাধনীদের। 
সূত্র: দৈনিক প্রথমআলো, ০৬ নভেম্বর, ২০১৩

0 comments

আপনার মন্তব্য লিখুন