হরতালে বেসামাল অর্থনীতি

দিনমজুর শুক্কুর আলী খুব ভোরে কাজের সন্ধানে বাসা থেকে বের হন। সারাদিন মজুরের কাজ করে যা পান, তাই দিয়ে চলে তার সংসার। দিন এনে দিন খাওয়া এ মানুষটি পরিবার-পরিজন নিয়ে বেকায়দায় পড়ে গেছেন। দু'মুঠো ভাত জোগাড় করতে গিয়ে চোখেমুখে এখন অন্ধকার দেখছেন তিনি। টানা হরতালে তিনি কাজ পান না। এভাবে হরতাল চলতে থাকলে তার সংসার চলবে কীভাবে- সেই দুশ্চিন্তা পেয়ে বসেছে তাকে। ছয়জনের পরিবার নিয়ে রাজধানীর মিরপুর মাজারের পেছনে ছোট একটি ঘরে থাকেন তিনি।
দেশের জনসংখ্যার বড় একটি অংশ শুক্কুর আলীর মতো দিনমজুর, যাদের সংসারে নুন আনতে পান্তা ফুরায়। হরতালে স্বাভাবিক কাজ ব্যাহত হওয়ায় তাদের রোজগারের পথ রুদ্ধ হয়ে গেছে। হরতালের বিরূপ প্রভাবে জনজীবনে দুর্ভোগের পাশাপাশি বিপন্ন হয় অর্থনীতি।
হরতাল-অবরোধে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয় রফতানিমুখী খাত, বিশেষত তৈরি পোশাকশিল্প। পণ্য পরিবহন বাধাগ্রস্ত হওয়ায় শিপমেন্ট বা জাহাজীকরণ করা সম্ভব হয় না। ফলে ক্রেতার কাছে যথাসময়ে রফতানি পণ্য পৌঁছানো যায় না।
ক্ষতিগ্রস্ত অন্যান্য খাতের মধ্যে পর্যটন, হোটেল-রেস্তোরাঁ উল্লেখযোগ্য। রাজনৈতিক অস্থিরতা থাকলে বিদেশি পর্যটকরা আসেন না। হরতালে স্বাভাবিক দিনের চেয়ে লোক কম বাইরে বের হয়। যে কারণে হোটেল-রেস্তোরাঁয় বেচাকেনা কমে যায়।
অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা বলছেন, নানা প্রতিকূলতা সত্ত্বেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশের অর্থনীতি এগিয়ে চলছে। সংঘাতময় রাজনীতির কবলে পড়ে দেশের সেই অর্থনীতি এখন বেসামাল।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আইএমএফের সাবেক কর্মকর্তা ড. আহসান এইচ মনসুর সমকালকে বলেন, হরতালে বেশি প্রভাব পড়ে পণ্য পরিবহনে। ফলে রফতানি খাত সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
বহুজাতিক দাতা সংস্থা বিশ্বব্যাংক ও এডিবি বলেছে, রাজনীতিতে যে অস্থিরতা চলছে, তার শান্তিপূর্ণ সমাধান না হলে এ বছর কাঙ্ক্ষিত প্রবৃদ্ধি অর্জন হবে না।
উল্লেখ্য, চলতি অর্থবছরে জিডিপির প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ৭ দশমিক ২ শতাংশ।
 
আর্থিক ক্ষতি: ঢাকা চেম্বারের সাম্প্রতিক এক সমীক্ষা অনুযায়ী প্রতিদিন হরতালে আর্থিক ক্ষতি ১ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত দেশে হরতাল হয়েছে ৪৫ দিন। সে হিসাবে ওই সময় পর্যন্ত মোট ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৭২ হাজার কোটি টাকা। এই টাকা দিয়ে তিনটি পদ্মা সেতু তৈরি সম্ভব। প্রাণহানি ও সম্পদের যে ক্ষতি হয়েছে, এ হিসাব তার বাইরে।
বিশ্বব্যাংকের এক হিসাবমতে, হরতালের বিরূপ প্রভাবে বাংলাদেশে প্রতিবছর মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপির প্রায় ১ শতাংশ ক্ষতি হয়।
জাতিসংঘের উন্নয়ন সংস্থা ইউএনডিপি এ ক্ষতির পরিমাণ আরও বেশি বলে দাবি করেছে। আন্তর্জাতিক এই সংস্থা এক সমীক্ষায় বলেছে, হরতালের কারণে বাংলাদেশে সার্বিক ক্ষতি হয় জিডিপির কমপক্ষে ৩ থেকে ৪ শতাংশ।
 
উল্লেখ্য, বাজারমূল্যে বর্তমানে বাংলাদেশের অর্থনীতির আয়তন (জিডিপি) ১০ লাখ কোটি ৩ লাখ ৭৯ হাজার ৮৬৭ টাকা, যা শতকরা হারে ৬ দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ।
হরতালজনিত ক্ষতি নিয়ে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সিপিডি একটি হিসাব প্রাক্কলন করেছে। সিপিডি বলেছে, হরতালে ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ডে মূলধনজনিত বিনিয়োগ (ক্যাপিটাল স্টক) ১ শতাংশ কমে গেলে জিডিপি কমে যাবে শূন্য দশমিক ৯ শতাংশ, রফতানি আড়াই শতাংশ; কর্মসংস্থান সংকুচিত হবে শূন্য দশমিক ৯ শতাংশ।
সিপিডির অতিরিক্ত গবেষণা পরিচালক ড. খোন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম সমকালকে বলেন, হরতালে বড় ক্ষতি হচ্ছে ব্যবসা-বাণিজ্যে আস্থার সংকট। এটা দীর্ঘ মেয়াদে হলে অর্থনৈতিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হবে।
 
বিজিএমইএর হিসাব: তৈরি পোশাক মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ দাবি করেছে, একদিনের হরতালে পোশাক খাতে ক্ষতির পরিমাণ ১৫০ কোটি টাকা।
সংগঠনের সহসভাপতি শহীদুল্লাহ আজিম সমকালকে বলেন, পরিবহন বন্ধ থাকায় পণ্য বন্দরে পৌঁছানো সম্ভব হয় না। যথাসময়ে শিপমেন্ট না হওয়ায় আদেশ বাতিল করে দেন ক্রেতারা।
বিজিএমইএ সূত্রে জানা গেছে, সংঘাতময় রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে অন্তত ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ রফতানি আদেশ বাংলাদেশের হাতছাড়া হয়ে গেছে।
 
বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি আনোয়ার-উল আলম পারভেজ চৌধুরী বলেন, সংঘাতময় রাজনীতির নেতিবাচক বার্তা বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করছে। ফলে বিদেশিরা বাংলাদেশ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে।
 
রাজস্ব ক্ষতি: জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, একদিনের হরতালে ৪০ কোটি টাকা রাজস্ব ক্ষতি হয়।
হরতালে স্বাভাবিক কাজকর্ম বন্ধ থাকলে কী পরিমাণ রাজস্ব আদায়ে ক্ষতি হয়, তা জানতে সম্প্রতি এ প্রতিবেদন তৈরি করেছে এনবিআর। রাজস্ব আদায়ের দিক থেকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও বড় চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসে প্রতিদিন প্রায় চার হাজার পণ্যের চালান খালাস হয়। হরতালের কারণে চালানগুলো সরবরাহ করা সম্ভব হয় না।
এ ছাড়া সবচেয়ে বড় স্থলবন্দর বেনাপোলে আটকে থাকে ৪০০টি, ঢাকা কাস্টম হাউসে ৬০০ থেকে ৭০০ ও কমলাপুর আইসিডিতে ৫০-৬০টি চালান। হরতালজনিত কারণে মালপত্র খালাস না হওয়ায় সরবরাহে ব্যাঘাত ঘটে। এতে ব্যবসা-বাণিজ্যে স্থবিরতা দেখা দেয়।
 
দিনমজুরদের কথা: আগের চেয়ে এখনকার হরতালের রূপ আরও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে। বাসে আগুন, ট্রেনলাইন উপড়ে ফেলা, বিদ্যুৎকেন্দ্র জ্বালিয়ে দেওয়ার মতো নাশকতা ঘটছে।
বাস কন্ডাক্টর আসলাম জানান, একদিন ডিউটি করলে ৫০০ টাকা পান। হরতালের ভয়ে তার মালিক বাস রাস্তায় নামাননি। জীবনের চেয়ে টাকা বড় নয়- এ মন্তব্য করেন আসলাম। রাজধানীর মিরপুর থেকে সায়েদাবাদ রোডে মিনিবাসে কন্ডাক্টরি করেন আসলাম।
আগারগাঁওয়ের রিকশাচালক আলম বলেন, হরতালের দিন দুপুর পর্যন্ত মহাজনকে জমা দেওয়ার টাকাই ওঠে না। ছয়জনের পরিবার নিয়ে বিএনপি বস্তিতে থাকেন আলম।
সূত্র: দৈনিক সমকাল, ০৮ নভেম্বর ২০১৩

,

0 comments

আপনার মন্তব্য লিখুন